আমি বুঝতে পারছিলাম এভাবে আর কিছুক্ষণ চলতে থাকলে সবাই মারা পড়বে। দু এক জনকে রবোটগুলোকে যেভাবে হোক আটকে রাখতে হবে, অন্যেরা যেন পালিয়ে যেতে পারে। পিছনে বাই ভার্বালগুলো আছে সেগুলোতে করে দ্রুত সরে যেতে হবে। আমি ইশিকে সেরকম কিছু বলার জন্যে মাথা উঁচু করেছি ঠিক তখন রবোটগুলো তাদের অস্ত্র নামিয়ে নিল। গোলাগুলি থেমে গেল হঠাৎ এবং আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলাম রবোটগুলো পিছিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই বাই ভার্বালের শব্দ শুনতে পেলাম, সত্যি সত্যি সেগুলো দিয়ে তারা ফিরে যেতে শুরু করেছে।
আমরা ধীরে ধীরে আড়াল থেকে বের হয়ে আসি। ধুলায় ধূসর হয়ে আছে একেকজন, ভালো করে না তাকালে চেনা যায় না। ক্লডের কপালের কাছে কোথায় কেটে গেছে, রক্তে মুখ মাখামাখি হয়ে আছে। দ্রুনকে দেখতে পেলাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে মুখ বিকৃত করে। মাটিতে বসে পড়ল। ইশি উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, কী অবস্থা আমাদের! সবাই কি ঠিক আছে?
আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম আমাদের মাঝে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই মারা গেছে, কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম ধ্বংসস্তূপের মাঝে থেকে এক জন এক জন করে সবাই বের হয়ে আসতে থাকে। কারো হাতপা বা মাথা কেটে রক্ত বের হচ্ছে, কেউ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে
কিন্তু সবাই যে বেঁচে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সবার চোখেমুখে এক ধরনের অবিশ্বাস্য আতঙ্ক, মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা এখনো যেন বুঝে উঠতে পারছে না। ইশি আবার জিজ্ঞেস করল, সবাই কি ঠিক আছে?
ক্লড তার কপালের ক্ষতটি হাত দিয়ে ধরে রেখে বলল, মনে হয়। ছোটখাটো আঘাত আছে, কিন্তু বড় আঘাত মনে হয় নেই। অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না এটা অবিশ্বাস্য নয়। এর পিছনে কারণ আছে। কী কারণ?
আমরা গেটওয়ে কম্পিউটারকে ঘিরে ছিলাম, সে জন্যে সোজাসুজি আমাদের দিকে গুলি করে নি। এই রবোটগুলোর জন্যে সোজাসুজি গুলি করে আমাদের বাতাসে মিশিয়ে দেয়া খুব কঠিন না। তার মানে এই কম্পিউটারটা গ্রুস্টানের জন্যে মনে হয় খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মনে হয়।
ইশি আবার সবার দিকে তাকিয়ে বলল, সবাই কি সত্যিই এখানে আছে? নাইনা কোথায়?
অন্ধকার এক কোনা থেকে বলল, এই যে এখানে।
রাইনুক?
এই যে
এলুজ?
এই যে–
ক্লড হঠাৎ যন্ত্রণার মতো একটু শব্দ করে বলল কপালের কাটাটা থেকে রক্ত বন্ধ করতে পারছি না। টিয়ারা একটু দেখবে—
কেউ কোনো কথা বলল না। আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে বললাম, টিয়ারা? টিয়ারা কোথায়?
সবাই চারদিকে ঘুরে তাকাল। কোথাও নেই টিয়ারা। একসাথে অনেকে চিৎকার করে ওঠে, টিয়ারা! টিয়ারা!
কেউ কোনো উত্তর দিল না। ভয়ঙ্কর একটা নৈঃশব্দ্য নেমে আসে হঠাৎ, আমি বুকের ভিতরে আশ্চর্য এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি। আমি প্রায় হাহাকারের মতো করে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ ক্রিশি একটু নড়ে উঠে–আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মহামান্য কুশান। একটা খুব জরুরি ব্যাপার।
কী?
মহামান্য টিয়ারাকে রবোটের দল ধরে নিয়ে গেছে গ্রুস্টানের কাছে। আর কয়েক মিনিটের মাঝেই তারা বসতিতে পৌঁছে যাবে। গ্রুস্টান সেখানে অপেক্ষা করছে তার জন্যে।
আমার হঠাৎ মনে হল আমি বুঝি দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। আমি এক পা পিছিয়ে এসে একটা দেয়াল স্পর্শ করে সাবধানে মাটিতে বসে পড়ি। আমি আর কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম না, আশপাশে সবাই উত্তেজিত গলায় কিছু একটা বলছে কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পারছিলাম না। আমার বুকের মাঝে এক ভয়ঙ্কর ক্রোধ আর তীব্র হতাশা জমে উঠতে থাকে। ইচ্ছে করতে থাকে ভয়ঙ্কর এক চিৎকার করে সমস্ত পৃথিবীকে ছিন্নভিন্ন করে উড়িয়ে দিই।
কুঁই কুঁই শব্দ করে কুকুরের বাচ্চাটি তখনো আমাদের পায়ের কাছে শুকতে শুকতে ঘোরাঘুরি করছে। আমি তার ভাষা জানি না কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না সে টিয়ারাকে খুঁজছে।
.
খুব ধীরে ধীরে যখন আকাশ ফরসা হয়ে ভোর হয়ে এল আমরা তখনো চুপচাপ কম্পিউটার ঘরে বসে আছি। কেউ বিশেষ কথা বলছে না শুধুমাত্র কুকুরের বাচ্চাটি তখনো ইতস্তত ঘুরে ঘুরে টিয়ারাকে খুঁজে যাচ্ছে। ইশি খানিকক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ উপরে তুলে বলল, আমরা টিয়ারাকে কেমন করে উদ্ধার করব?
কেউ কোনো কথা বলল না, কিন্তু সবাই মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালাম। আমার মাথার মাঝে মনে হয় সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে, আমি ঠাণ্ডা মাথায় কিছু ভাবতে পারছি না।
ইশি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কুশান, আমরা টিয়ারাকে কেমন করে উদ্ধার করব?
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, এতক্ষণে টিয়ারাকে নিশ্চয়ই সিলাকিত করা হয়ে গেছে। তাকে উদ্ধার করার সত্যি কোনো উপায় আছে কি না আমি জানি না।
সবাই চুপ করে বসে রইল। দীর্ঘ সময় ইতস্তত করে নাইনা বলল, কিন্তু আমরা কিছু করব না?
আমি কিছু না বলে নাইনার দিকে তাকালাম, নাইনা সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেলে। রাইনুক একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা যদি কিছু করতে চাই তাহলে এই মুহূর্তে এখান থেকে আমাদের চলে যেতে হবে। গ্রুস্টান জানে আমরা এখানে
ইশি বলল, কিন্তু জায়গাটা মনে হয় নিরাপদ। কুশান মনে হয় ঠিকই বলেছে, এই গেটওয়ে কম্পিউটারের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্যে আমাদের উপর সোজাসুজি আঘাত করবে না।