আমি আর রাইনুক হলঘরের মাঝামাঝি পা মুড়ে বসে পড়ি। গ্রুস্টান যতবার আমাদের সামনে দেখা দিয়েছে ততবার আমাদের মেঝেতে পা মুড়ে বসতে হয়েছে। অপার্থিব কোনো ব্যক্তিকে সম্মান দেখানোর এই পদ্ধতিটি প্রাচীন কিন্তু নিঃসন্দেহে কার্যকরী। আমি মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালাম। বেশিরভাগ মানুষই চুপ করে বসে আছে। যারা কথা বলছে তাদের গলার স্বর নিচু এবং চোখে এক ধরনের চকিত দৃষ্টি। একটু পরে পরে মাথা ঘুরিয়ে দেখছে। কান পেতে থাকলে ঘরে নিচু শব্দতরঙ্গের এক ধরনের ভোঁতা শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোনো একটি শক্তিশালী পাওয়ার সাপ্লাই চালু করা হয়েছে। আমি সামনে তাকালাম, একটু খুঁটিয়ে দেখার পরই চার কোনায় লেজাররশ্মি নিয়ন্ত্রণের জন্যে শক্তিশালী লেন্সগুলো চোখে পড়ল। ঘরের মেঝে থেকে ছোট ঘোট টিউব বের হয়ে এসেছে; তরল নাইট্রোজেনের সাথে জলীয় বাষ্প মিশিয়ে সাদা ধোঁয়ার মতো কিছু বের করা হবে। সংবেদী স্পিকারগুলো অনেক খুঁজেও বের করতে পারলাম না, নিশ্চয়ই সেগুলো হলঘরের দেয়ালে, ছাদে, মেঝেতে যত্ন করে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। গ্রুস্টানের দেখা দেয়ার সময় পুরো ব্যাপারটির নাটকীয় অংশটুকু খুব যত্ন করে করা হয়।
ঘরে যে মৃদু কথাবার্তা হচ্ছিল হঠাৎ সেটি থেমে যায়, আমি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি লিয়ানা এসেছে। লিয়ানার বয়স খুব বেশি নয়, অন্তত দেখে মনে হয় না। তার চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য রয়েছে কিন্তু শরীরটি অপূর্ব। অর্ধস্বচ্ছ নিও পলিমারের একটি কাপড়ের নিচে তার সুডৌল শরীরটি আবছা দেখা যাচ্ছে। সুগঠিত বুক, মেদহীন কোমল দেহ, মসৃণ ত্বক। তার চুলে এক ধরনের ধাতব রং সেগুলো মাথার উপরে ঝুঁটির মতো করে বাঁধা। লিয়ানার চোখের মণি নীল, দেখে মনে হয় সেখানে আকাশের গভীরতা।
লিয়ানা কোনো কথা না বলে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, আমরা সবাই হাত নেড়ে তার প্রত্যুত্তর দিলাম। সে সামনে রাখা কার্পেটে পা ভাঁজ করে বসে পড়ে, তার ভঙ্গিটি খুব সপ্রতিভ এবং সাবলীল। তাকে দেখতেও বেশ লাগে, পুরুষমানুষের কামনাকে প্রশ্রয় দেয় বলেই কি না কে জানে। আমি যতদূর জানি লিয়ানা একা থাকতে ভালবাসে। মাঝে মাঝে বসতির কোনো সুদর্শন পুরুষকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয় কিন্তু কখনো একজনের সাথে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছে বলে মনে পড়ে না।
লিয়ানা প্লাটিনামের পাত্র থেকে সবুজ রঙের তরলটি চুমুক দিয়ে খেয়ে যোগাযোগ মডিউলটি স্পর্শ করতেই ঘরের আলো আস্তে আস্তে নিষ্প্রভ হয়ে আসতে থাকে। আমরা লিয়ানার গলার স্বর শুনতে পেলাম, তার গলার স্বরটি একটু শুষ্ক, দীর্ঘ সময় উচ্চৈঃস্বরে কথা বলে গলার স্বর একটু ভেঙে গেলে যেরকম শোনায় অনেকটা সেরকম। সে চাপা গলায় বলল, মহান গ্রুস্টান আসছেন আমাদের কাছে। তোমরা সবাই আমার সাথে মাথা নিচু করে সম্মান প্রদর্শন কর মহামান্য গ্রুস্টানকে। গ্রুস্টান! আমাদের জীবন রক্ষাকারী গ্রুস্টান। মহান সর্বশক্তিশালী গ্রুস্টান।
আমরা মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বললাম, মহান সর্বশক্তিশালী গ্রুস্টান।
হলঘরের সামনের অংশটুকু এক ধরনের সাদা ধোঁয়ায় ঢেকে যেতে থাকে। তরল নাইট্রোজেন বাষ্পীভূত হয়ে ঘরটাকে শীতল করে দেয়, আমি একটু শিউরে উঠি। খুব ধীরে ধীরে একটি সঙ্গীতের সুর বেজে ওঠে, সেটি একই সাথে সুখ এবং বিষাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। সঙ্গীতের লয় দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে, সুখ এবং বিষাদের পরিবর্তে হঠাৎ আনন্দ এবং শঙ্কার অনুভূতি প্রবল হয়ে আসে। ধীরে ধীরে সঙ্গীতের সুর মানুষের আর্তচিৎকার আর হাহাকারের মতো শোনাতে থাকে। ধীরে ধীরে সেই শব্দ বেড়ে উঠে হলঘরের দেয়াল থেকে প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করে, আমরা এক ধরনের আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলি। হঠাৎ করে সমস্ত শব্দ থেমে গিয়ে এক ধরনের ভয়ঙ্কর নৈঃশব্দ্য নেমে আসে। আমরা চোখ খুলে তাকালাম, দেখতে পেলাম আমাদের সামনে শূন্যে গ্রুস্টান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হালকা সবুজ রঙের দেহ মনে হয় কেউ জেড পাথর কুঁদে তৈরি করেছে। শরীর থেকে এক ধরনের স্বচ্ছ আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। অপূর্ব কান্তিময় মুখাবয়ব, একই সাথে মানব এবং মানবী। একই সাথে কঠোর এবং কোমল। একই সাথে হাসিখুশি এবং বিষাদগ্রস্ত। তার দেহ এক ধরনের অর্ধস্বচ্ছ কাপড়ে ঢাকা, একদৃষ্টে সে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে সে দুই হাত উপরে তুলে ভারি গমগমে গলায় কথা বলে ওঠে, আমার প্রিয় মানুষেরা, তোমাদের জন্যে আমার ভালবাসা।
আমরা নিচু গলায় বললাম, ভালবাসা। আমাদের ভালবাসা।
তোমাদের সামনে আসতে পেরে আমি ধন্য।
আমরা বললাম, ধন্য। আমি ধন্য।
আমি অভিভূত।
আমি অভিভূত। অভিভূত।
তোমাদের জন্যে রয়েছে অভূতপূর্ব সুসংবাদ। গোপন এক কুঠুরিতে আবিষ্কার করেছি বিশাল প্রোটিনের সম্ভার। তোমাদের জন্যে রয়েছে অঢেল খাবার।
আমরা হর্ষধ্বনি করে চিৎকার করে উঠি, জয়! মহান গ্রুস্টানের জয়!
নূতন নেটওয়ার্কে যুক্ত করেছি আরেকটি বিশাল ভূখণ্ড সেখানে আবিষ্কার করেছি আরো একটি জনপদ।
জয়! মানুষের জয়!
পাহাড়ের গুহায় খুঁজে পেয়েছি ওষুধের কারখানা। সেখানে রয়েছে দীর্ঘ সময়ের জন্যে অঢেল প্রয়োজনীয় ওষুধ। রোগশোকের বিরুদ্ধে রয়েছে তোমাদের আশ্চর্য নিরাপত্তা।