ক্রিশি আমার কথার কোনো উত্তর দিল না, সাথে সাথে আমি হঠাৎ করে পুরোপুরি জেগে উঠলাম। ক্রিশির কপোট্রন কোনোভাবে জ্যাম করে দেয়া হয়েছে। যার অর্থ কোনো ধরনের রবোটেরা এসে আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। রবোটেরা মানুষকে বিশেষ কিছু করতে পারে না কিন্তু নিচু স্তরের রবোটদের খুব সহজেই জ্যাম করে দিতে পারে। আমি লাফিয়ে উঠে বসতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। মাথার কাছে রাখা অস্ত্রটি টেনে নিয়ে আমি গড়িয়ে বড় একটা কক্রিটের চাইয়ের পিছনে শুয়ে পড়ি। আমার পায়ের কাছে ইশি শুয়েছিল, আমি চাপা গলায় তাকে ডাকলাম, ইশি–
ইশির ঘুম খুব হালকা, সে সাথে সাথে জেগে বলল, কী হয়েছে কুশান?
মনে হয় গ্রুস্টানের রবোটেরা এসেছে। সবাইকে জাগিয়ে দাও। বল অস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকতে।
ইশি গুড়ি মেরে পিছনে সরে গেল, কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই জেগে উঠে বড় বড় কংক্রিটের চাঁই, ধাতব সিলিন্ডার বা ধসে পড়া দেয়ালের পিছনে আড়াল নেয়। আমি চাপা গলায় বললাম, মনে রেখো সবাই, লক ইন না করে গুলি করবে
আমার কথা শেষ হবার আগেই মাথার উপর দিয়ে শিস দেয়ার মতো শব্দ করে কী একটা উড়ে গেল। পর মুহূর্তে পিছনে একটা ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম। সাথে সাথে প্রচণ্ড আলোর ঝলকানিতে চারদিকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আমি আগুনের একটা গরম। হলকা অনুভব করি। উপর থেকে কী একটা জিনিস ভেঙে পড়ে ধুলায় ধূসর হয়ে যায় চারদিক।
আমি অস্ত্রটা তাক করে উবু হয়ে শুয়ে থাকি। আবছা অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো কিছু একটা এগিয়ে এল, হাতে একটা ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্র। সেটি উপরে তুলে রবোটটি ধাতব গলায় উচ্চৈঃস্বরে বলল, আমি ক্লিও প্রজাতির প্রতিরক্ষা রবোট। ক্রমিক সংখ্যা দুই শ নয়। মহামান্য গ্রুস্টান আমাদেরকে এখানে পাঠিয়েছেন। তোমরা মানুষেরা আমার বন্দি। দুই হাত উপরে তুলে এক জন এক জন করে বের হয়ে আস।
রবোটটি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আমি তার আগেই অস্ত্রটি তাক করে ট্রিগার টেনে ধরলাম। রবোটটির শরীরের উপরের অর্ধেক বাষ্পীভূত হয়ে গেল সাথে সাথে। কোনোকিছু ধ্বংস করার জন্যে বাহাত্তরের এই অস্ত্রটির কোনো তুলনা নেই।
চমৎকার কাজ কুশান!
কথাটি কে বলল ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজনও নেই। আমি আমার জায়গাটি থেকে পিছিয়ে সরে যাচ্ছিলাম কিন্তু টের পেলাম ঠিক আমার পিছনে কেউ একজন গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আমি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কে?
আমি! আমি টিয়ারা।
টিয়ারা?
হ্যাঁ কুশান–সে গুড়ি মেরে আমার পাশে এসে হাজির হয়। আবছা অন্ধকারে আমি তার দিকে তাকালাম, ভীতমুখে সে সামনে তাকিয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, আমার ভয় করছে কুশান। ভীষণ ভয় করছে।
আমার বুকের ভিতর হঠাৎ যেন ভালবাসার একটি প্লাবন ঘটে গেল। আমি হাত দিয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করে বললাম, তোমার কোনো ভয় নেই টিয়ারা। কোনো ভয় নেই।
টিয়ারা একটি শিশুর মতো আমার গলা জড়িয়ে ধরে মুখে মুখ ঘষে তৃষিতের মতো আমাকে চুম্বন করতে করতে বলল, বল তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না। বল।
আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না–
আমার কথা শেষ হবার আগেই মাথার উপর দিয়ে শিসের মতো একটি শব্দ হল এবং সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চারদিক কেঁপে ওঠে। আমি মাথা উঁচু করে সামনে তাকালাম। অন্ধকার থেকে সারি বেঁধে রবোটের দল হাজির হচ্ছে। একটি দুটি নয়, অসংখ্য। সবার হাতে ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্র। রবোটগুলো বৃত্তাকারে আমাদের ঘিরে ফেলার চেষ্ট করছে। কাছাকাছি এগিয়ে আসা একটি রবোট ধাতব গলায় বলল, মহামান্য গ্রুস্টান তোমাদের মৃত কিংবা জীবিত ধরে নেয়ার আদেশ দিয়েছেন। তোমরা হাত তুলে
অন্য পাশ থেকে কেউ একজন তার এটমিক ব্লাস্টার টেনে ধরে। লেজার রশ্মির নীল আলো দেখা গেল এবং মুহূর্তের মাঝে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে রবোটদের একটা বড় অংশ ভস্মীভূত হয়ে যায়। রবোটগুলো সাথে সাথে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে তাদের অস্ত্র তুলে ধরে গুলি করতে শুরু করে। আমি চিৎকার করে বললাম, সাবধান! কাছে আসতে দিও না।
ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে পুরো এলাকাটি নারকীয় হয়ে ওঠে। আমি প্রাণপণে গুলি করতে থাকি, রবোটগুলো একটার পর আরেকটা বিধ্বস্ত হতে থাকে কিন্তু তবু তাদের থামিয়ে রাখা যায় না। সেগুলো তবু মাথা উঁচু করে গুলি করতে করতে সোজা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মনে হতে থাকে রবোটগুলো যে কোনো মুহূর্তে আমাদের রক্ষণব্যুহ ভেঙে ঢকে যাবে। শুনতে পেলাম ইশি চিৎকার করে বলল, পিছিয়ে যাও–পিছিয়ে যাও সবাই।
টিয়ারা আমার কনুইয়ের কাছে খামচে ধরে, আমি তার হাত স্পর্শ করে বললাম, ভয় পেয়ো না টিয়ারা, ভয় পেয়ো না–পিছিয়ে গিয়ে ওই বড় দেয়ালটার পিছনে আড়াল নাও।
তুমি?
আমি আসছি।
টিয়ারা মাটিতে নিচু হয়ে শুয়ে পিছনে সরে যেতে থাকে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে হঠাৎ চারদিক আলোকিত হয়ে ওঠে, আমি আগুনের গরম হলকা অনুভব করলাম, বিকট শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। উপর থেকে কী যেন ভেঙে পড়ল, চারদিক ধুলায় অন্ধকার হয়ে গেল মুহূর্তের জন্যে। আমি মাথা উঁচু করে দেখলাম সবাই গুলি করতে করতে পিছনে সরে যাচ্ছে। আমি নিজেও তখন পিছনে সরে যেতে শুরু করলাম, রবোটগুলো কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে এগিয়ে আসতে থাকে। আমাদের কয়েকজন হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে ছুটতে থাকে, রবোটগুলো অস্ত্র হাতে গুলি করতে করতে ছুটে যাচ্ছে, চিৎকার, চেঁচামেচি, ভয়ঙ্কর শব্দে এখানে হঠাৎ যেন নরক নেমে এল।