ক্লড ঘরের ভিতর হাঁটাহাঁটি করতে থাকে। বিভিন্ন চৌকোণা তার এবং টিউবগুলো দেখতে দেখতে সে আবার নিজের মনে কথা বলতে শুরু করে। আমি একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে ক্লডের মোটামুটি অর্থহীন এবং প্রায় ছেলেমানুষি কথা শুনতে থাকি।
ক্লড হঠাৎ কী একটা দেখে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, কুশান!
কী হল?
কাছে এসে দেখ।
আমি এগিয়ে গেলাম, সে হলুদ রঙের কী একটা তার ধরে রেখেছে, আমাকে দেখিয়ে এমন একটা ভঙ্গি করল যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী এটা?
এই দেখ! মূল প্রসেসর থেকে মেমোরি মডিউলের যোগাযোগ। একেবারে সোনার খনি!
কেন?
কোয়ার্টজ ফাইবার, সেকেন্ডে লক্ষ টেরাবিট তথ্য যাচ্ছে। আমরা যদি চাই তাহলে কী তথ্য যাচ্ছে বের করে ফেলতে পারি?
কেমন করে?
মনে নাই আগে বলেছিলাম তোমাদের? একেবারে পানির মতো সহজ। প্রথমে উপরের আবরণ সরিয়ে ভিতর থেকে কোয়ার্টজের মূল ফাইবারটা বের করতে হবে। তারপর সেটা যদি একটু বাঁকা করে ধর, ভিতর থেকে খুব অল্প অবলাল রশ্মি বের হয়ে আসবে। সেখানে একটা ভালো ফটোডায়োড আর কিছু ভালো এমপ্লিফায়ার–ব্যস হয়ে গেল।
হয়ে গেল?
তথ্যটা বোঝার জন্যে কিছু মনিটর লাগবে। একটা ছোট সমস্যা–ক্লড ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আবার কথা বলতে শুরু করে। মানুষটি মনে হয় জোরে জোরে চিন্তা করে।
আমি ক্লডের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম সে যেটা করতে চাইছে ব্যাপারটি অসম্ভব কিছু নয়। দীর্ঘদিন থেকে আমরা যে তথ্যগুলো বের করার চেষ্টা করছি এই কম্পিউটার গেটওয়ে থেকে দু–তিন দিনে সেইগুলো বের করে নিতে পারব। গ্রুস্টান যদি একজন মানুষ হত তাহলে তার মস্তিষ্কে উঁকি দিয়ে মনের কথা শুনে ফেলার মতো ব্যাপারটি।
আমি আর ক্লড জায়গাটি ভালো করে পরীক্ষা করে ফিরে গেলাম। ঠিক কী করতে চাইছি শোনার পর দলের সবাই খুব উৎসাহী হয়ে ওঠে। হঠাৎ করে পুরো দলের মাঝে এক নূতন ধরনের উদ্দীপনা ফিরে আসে। আমরা পুরো দলবল নিয়ে পরের দিনই গেটওয়ে কম্পিউটারে পৌঁছে কাজ শুরু করে দিলাম।
.
ক্লড দাবি করেছিল দুই দিনের মাঝে আমরা কম্পিউটারের মেমোরিতে উঁকি দিয়ে তথ্য বের করতে শুরু করব। কিন্তু দেখা গেল ব্যাপারটি এত সহজ নয়। দলের সবাই রাতদিন কাজ করার পরও বড় একটা মনিটরে আবছা আবছাভাবে কিছু ত্রিমাত্রিক ছবি দেখা ছাড়া বিশেষ কোনো লাভ হল না। আমরা পালা করে সেই ত্রিমাত্রিক ছবিগুলোই পরীক্ষা করতে থাকি–সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য বের হয়ে যাবে সেই আশায়।
এভাবে আরো কয়েকদিন কেটে যায়। ইশি ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। একদিন রাতে আমি যখন বিশ্রাম নেবার জন্যে শুতে যাচ্ছি ইশি বলল, আমরা ঠিক করেছিলাম এক জায়গায় খুব বেশি সময় থাকব না। কিন্তু এখানে আমরা প্রায় দুই সপ্তাহের মতো কাটিয়ে দিয়েছি। ব্যাপারটা ভালো হল না।
ক্লড কাছেই বসেছিল। মাথা চুলকে বলল, ফটোডায়োডের ব্যান্ড উইডথ ভালো নয়। অনেক তথ্য নষ্ট হচ্ছে। যেটুকু অবলাল রশ্মি পাচ্ছি সেটা যথেষ্ট নয়। আরেকটু যদি পেতাম!
দ্রুন বলল, কিন্তু তাহলে গ্রুস্টান বুঝে ফেলবে।
ইশি মাথা নেড়ে বলল, না না, সেটা খুব বিপজ্জনক কাজ হবে।
আমি বললাম, ক্লড, তোমরা সবাই মিলে যে কাজটুকু করছ, বলা যেতে পারে সেটা এক রকম অসাধ্য সাধন। কোনোরকম ঝুঁকি নিয়ে কাজ নেই।
দ্রুন বলল, আমরা তথ্য মোটামুটি খারাপ বের করি নি। যেমন ধরা যাক কম্পিউটারের অবস্থান। আমাদের আগের লিস্টে–অন্তত আরো কয়েক হাজার কম্পিউটার যোগ হয়েছে।
চমৎকার। ইশি মাথা নেড়ে বলল, চমৎকার।
আমি বললাম, আমরা এখানে যদি আরো কিছুদিন থাকি হয়তো আরো কিছু তথ্য বের করতে পারব। কিন্তু যদি গ্রুস্টানের হাতে ধরা পড়ে যাই সর্বনাশ হয়ে যাবে।
আমারও তাই ধারণা। ইশি মাথা নেড়ে বলল, এক জায়গায় দুই সপ্তাহ থাকা খুব বিপজ্জনক। আমার মনে হয় আমাদের এখন এখান থেকে সরে যাওয়া দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
ক্লড বলল, আর এক দিন। মাত্র এক দিন। মেমোরির মূল ব্যাংকে প্রায় পৌঁছে যাব মনে হচ্ছে, এক ধাক্কায় তখন অনেক কিছু বের হয়ে আসবে।
দ্রুন বলল, যদি দুই সপ্তাহ এক জায়গায় থাকতে পারি তাহলে আর এক দিন বেশি থাকলে ক্ষতি কী?
বিপদের আশঙ্কার কথা যদি বল তাহলে খুব বেশি পার্থক্য নেই।
ইশি বলল, ঠিক আছে তাহলে আমরা আরো একদিন থাকছি কিন্তু তারপর সরে পড়ব।
আমি বললাম, তোমাদের সবার কাছে একটা অস্ত্র রয়েছে না?
হ্যাঁ।
আমার মনে হয় অস্ত্রটি ভালো করে পরীক্ষা করে আজকে সবাই ঘুমাতে যেও। যদি গভীর রাতে রবোটেরা হানা দেয় মনে রেখো লক ইন না করে গুলি করবে। লক ইন করা হলে অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ হয় কিন্তু রবোটেরা টের পেয়ে যায়। রবোটেরা খুব সহজেই অন্য রবোটদের খুঁজে বের করতে পারে কিন্তু মানুষদের খুঁজে বের করা তাদের জন্যে খুব সহজ নয়।
উপস্থিত যারা ছিল সবাই চুপ করে আমার কথা শুনল, কেউ কিছু বলল না। আমি বুঝতে পারলাম হঠাৎ করে সবাই এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে শুরু করেছে।
গভীর রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি চোখ খুলে তাকালাম, আমার মাথার কাছে ক্রিশি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যখন ঘুমাই সে সবসময় আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু আজকে তাকে দেখতে একটু অন্য রকম লাগল। ঘুমের মাঝে আমি যখন হঠাৎ করে চোখ খুলে তাকাই ক্রিশি সবসময় আমাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু এবারে সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। আমি ঘুম চোখে ফিসফিস করে ডাকলাম, ক্রিশি।