চৌদ্দ জন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মানুষ পাশাপাশি থাকার কিছু সমস্যাও রয়েছে, যখন দীর্ঘ সময় কষ্টসাধ্য কাজ করে যেতে হয় তখন খুব সহজেই একে অন্যের ওপর রেগে ওঠে। ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মন কষাকষি শুরু হয় এবং হঠাৎ হঠাৎ চরিত্রের দুর্বল দিকগুলো প্রকাশ পেয়ে যায়। সমস্যাটি সবারই চোখে পড়ছে, সেটা নিয়ে মাঝে মাঝেই আলোচনা করা হয় যদিও ইশির ধারণা এটি সত্যিকারের কোনো সমস্যা নয়, নিজেদের ভিতরে ছোটখাটো বাকবিতণ্ডা করে ভেতরের ক্ষোভ বের করা মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যে অত্যন্ত জরুরি!
গোড়াতেই আমরা নিজেদের ভেতরে কয়েকটা জিনিস ঠিক করে রেখেছি। গ্রুস্টান নিশ্চয়ই আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে সে কারণে আমরা কখনোই এক জায়গায় দু–এক দিনের বেশি থাকি না। ব্যাপারটি সহজ নয় সবাই সেটা নিয়ে অল্পবিস্তর অভিযোগ করা শুরু করেছে কিন্তু এখনো নিয়মটি ভাঙা হয় নি। দলের সবাই কোনো–না–কোনো ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা শিখেছে এবং সবসময় অস্ত্রটি হাতের কাছে রাখা হয়। এমনিতে খাবার পানীয় এবং ওষুধ খুঁজে বের করে বিভিন্ন নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। চলাফেরা করার জন্যে কিছু বাই ভার্বাল থাকায় আমরা বেশ দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে পারি। আমরা আমাদের নূতন জীবনে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, সবসময়েই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে খানিকটা উত্তেজনা থাকে এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ব্যাপারটি সবাই উপভোগ করা শুরু করেছে।
আমাদের প্রথম কাজ তথ্য সগ্রহ করা। গ্রুস্টান তার নানা কম্পিউটারের যোগাযোগ রাখার জন্যে নানাভাবে তথ্য পাঠায়। সেই তথ্যগুলো মাইক্রোওয়েভ রিসিভার ব্যবহার করে শোনার চেষ্টা করা হয়। তথ্যগুলোতে খুব প্রয়োজনীয় কিছু থাকবে কেউ আশা করে না কিন্তু কোথায় কোথায় অন্য কম্পিউটারগুলো রয়েছে তার একটা ধারণা হয়। সপ্তাহখানেক চেষ্টা করে আরো প্রায় এক শ নূতন কম্পিউটারের অবস্থান বের করা হয়েছে, কাজটি খুব সময়সাপেক্ষ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এভাবে চলতে থাকলে সব কম্পিউটারের অবস্থান বের করতে করতে আমাদের পুরো জীবন পার হয়ে যাবার কথা কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য ঠিক এ রকম সময়ে আমাদের হাতে একটি অভাবিত সুযোগ এসে গেল।
ভোরবেলা আমি আর ক্লড বের হয়েছি, আমাদের সাথে একটা হাতে তৈরি করা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি মনিটর। দক্ষিণে প্রায় চার শ কিলোমিটার দূরে কোনো একটি জায়গা থেকে নির্দিষ্ট সময় পরে পরে মাইক্রোওয়েভের একটি ছোটখাটো বিস্ফোরণ হয়, ব্যাপারটি কী নিজের চোখে দেখে আসার ইচ্ছে। বাই ভার্বালে করে মাটির কাছাকাছি আমরা উড়ে যাচ্ছি, আমি হালকা হাতে কন্ট্রোল ধরে রেখেছি, কুড ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছে। একজন মানুষ যে বিনা কারণে এত কথা বলতে পারে ক্লডকে না দেখলে আমি কখনো বিশ্বাস করতাম না।
যে জায়গাটি থেকে মাইক্রোওয়েভের বিস্ফোরণ হচ্ছে আমরা কিছুক্ষণেই সেখানে পৌঁছে গেছি। একটা ধূসর দালান, তার বেশিরভাগই ভেঙে গিয়েছে। তবুও বাইরে থেকে তাকিয়ে বোঝা যায় ভিতরে বড় অংশ এখনো মোটামুটি দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে কী আছে আমরা জানি না, কাছে গেলে আমাদের কোনো কিছু দেখে ফেলবে কি না বা অন্য কোথাও খবর পৌঁছে যাবে কি না সে ব্যাপারেও আমাদের কোনো ধারণা নেই। এ রকম সময়। সাধারণত একটা রবোটকে কাজ চালানোর মতো একটা ভিডিও ক্যামেরা হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। আজকেও তাই করা হল। রবোটটি প্রোগ্রাম করা আছে, গুটি গুটি হেঁটে ভিতর থেকে ঘুরে আসার কথা, বাই ভার্বালে বসে ছোট স্ক্রিনে আমরা দেখতে পাই কোথায় কী রয়েছে।
ভিতরে ছোট ছোট ঘর এবং তার ভিতরে চৌকোণো বাক্স, সেগুলো নানা ধরনের টিউব দিয়ে জুড়ে দেয়া আছে। আমি দেখে ঠিক বুঝতে পারলাম না কিন্তু ক্লডকে খুব উল্লসিত দেখা গেল, হাঁটুতে থাবা দিয়ে বলল, চমৎকার!
কী হয়েছে?
এটা গেটওয়ে কম্পিউটার।
তার মানে কী?
তার মানে এখানে মানুষের সাথে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নেই। আশপাশের অনেকগুলো কম্পিউটার এখানে এসে একত্র হয়েছে। একেবারে যাকে বলে সোনার খনি!
তুমি কেমন করে জান?
ক্লড স্ক্রিনে দেখিয়ে বলল, এই দেখ এগুলো হচ্ছে মূল প্রসেসর। কেমন করে সাজানো দেখেছ? বাইরে থেকে যোগাযোগের কোয়ার্টজ ফাইবার এসেছে এদিক দিয়ে। এখানে সাধারণত হলোগ্রাফিক মনিটর থাকে। এখানে নেই কারণ এটা গেটওয়ে কম্পিউটার। তা ছাড়া মেমোরি মডিউলগুলো দেখ কত বড়, উপরের টিউবগুলো নিশ্চয়ই ফ্রিণ্ডন টিউব, ঠাণ্ডা রাখার জন্যে দরকার। প্রসেসরের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে খুব কায়দা করে, ভালো। করে দেখ
ক্লড একটানা কথা বলে যেতে থাকে, তার বেশ কিছু আমি বুঝতে পারলাম না, কিন্তু কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হল ব্যাপারটি নিয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। সে বাই ভার্বাল থেকে নেমে বলল, চল ভিতরে যাই।
তুমি নিশ্চিত আমাদের কোনো বিপদ হবে না?
আমি নিশ্চিত।
কতটুকু?
শতকরা এক শ ভাগ!
আমি ক্লডের পিছু পিছু ঘরটির মাঝে ঢুকি। চারদিক ধুলায় ধূসর, কত দিন কোনো মানুষের পায়ের চিহ্ন পড়ে নি। কয়েকটা ছোট ছোট দরজা পার হয়ে বড় একটা ঘরে এসে দাঁড়ালাম। অসংখ্য চৌকোণো বাক্স পাশাপাশি রাখা আছে, সেখান থেকে নিচু এক ধরনের ধাতব শব্দ হচ্ছে। ঘরে এক ধরনের কটু গন্ধ।