সেটি কী?
সত্যি শুনবে? শোনার মতো কিছু নয়।
হ্যাঁ শুনব।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আমার স্বপ্ন যে আমি দক্ষিণে হেঁটে হেঁটে যাব। শুনেছি সেখানে নাকি একটা এলাকায় মানুষজনের বসতি ছিল না বলে পারমাণবিক বোমা দিয়ে ধ্বংস করা হয় নি। সেখানে গিয়ে আমি একটা নীল হ্রদ খুঁজে পাব। সেখানে থাকবে টলটলে পানি। সেই হ্রদের তীরে থাকবে গাছ। সত্যিকারের গাছ। সেই গাছে থাকবে গাঢ় সবুজ পাতা। আমি সেই গাছে হেলান দিয়ে হ্রদের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকব। আর
আর কী?
দেখব হ্রদের পানিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে রুপালি মাছ। দেখব আকাশে উড়ে যাচ্ছে পাখির ঝাক। কিচিরমিচির করে ডাকছে। তাদের গায়ের রং উজ্জ্বল সবুজ। লাল ঠোঁট। মাটিতে তাকিয়ে দেখব ভঁয়োপোক হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। হ্রদের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে থাকতে তাকিয়ে দেখব সূর্য উঠে যাচ্ছে মাথার উপরে আর তখন
তখন?
তখন আমার খুব খিদে পাবে। আমি তখন শুকনো কাঠ জড়ো করে আগুন ধরাব। তারপর একটা তিতির পাখি না হয় একটা কার্প মাছকে বিষুবীয় অঞ্চলের ঝাঁজালো মসলায় মাখিয়ে খাব। সাথে থাকবে যবের রুটি। আঙুরের রস আর তরমুজ। আর আমার পাশে থাকবে–
তোমার পাশে?
আমি হঠাৎ থেমে উঠে লক্ষ করলাম সবাই নিঃশব্দে আমার কথা শুনছে। আমি লজ্জা পেয়ে থেমে গেলাম হঠাৎ।
ইশি বলল, কী হল থামলে কেন? বল।
এগুলো ছেলেমানুষি কথা! শুনে কী করবে।
লাল চুলের মেয়েটি বলল, বল না শুনি। বহুকাল কারো মুখে এ রকম ছেলেমানুষি কথা শুনি নি। বড় ভালো লাগছে শুনতে।
জানি না কেন হঠাৎ আমার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। এই পৃথিবী, প্রকৃতি, আকাশ বাতাস সবকিছু একদিন মানুষের ধরাছোঁয়ার কাছাকাছি ছিল। এখন সেটি কত দূরে–তার একটু স্পর্শের জন্যে আমরা কত তৃষিত হয়ে থাকি।
০৯. একটি ছোট দলের জন্যে
একটি ছোট দলের জন্যে চৌদ্দ জন সংখ্যাটি খারাপ নয়। খুব বেশি নয় যে সবার সাথে সবাই যোগাযোগ রাখতে পারে না, আবার খুব কমও নয় যে, মোটামুটি একটা দুরূহ কাজ সবাই মিলে শুরু করা যায় না। খুব কাছাকাছি থাকতে হয় বলে খুব অল্প সময়েই আমরা সবার সাথে সবাই পরিচিত হয়ে উঠেছি। কার কোন বিষয়ে কোন ধরনের ক্ষমতা এবং কোন ধরনের দুর্বলতা রয়েছে আমরা দ্রুত জ্বেলে ফেলেছি। যেমন ইশি মানুষটির রসিকতাবোধ প্রবল নয় কিন্তু মানুষটি এক কথায় অসাধারণ। কোনোকিছুতেই সে নিরুৎসাহিত হয় না, যে ব্যাপারটিকে অতিদর্শনে একটা ভয়ঙ্কর মন খারাপ করা অবস্থা বলে মনে হয় তার মাঝেও সে চমৎকার আশাব্যঞ্জক কিছু একটা খুঁজে বের করে ফেলে। তার বিশেষ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নেই কিন্তু মানুষজনকে নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা অসাধারণ।
রাইনুককে আমি দীর্ঘদিন থেকে চিনি কিন্তু এখানে তাকে আমি একেবারে নূতনভাবে আবিষ্কার করলাম। তাকে একটা কোনো সমস্যা সমাধান করতে দেয়া হলে সে তার পিছনে খ্যাপার মতো লেগে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্যাটার সমাধান না হচ্ছে সে ঘুম খাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দেয়। ক্লড হাসিখুশি মানুষ, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল তাই তার সত্যিকার চেহারাটি কেমন জানি না। সে সবসময় কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলছে। দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু কম্পিউটারের হার্ডওয়ারে তার অসাধারণ জ্ঞান। গণিতবিদ দ্রুন ক্লডের ঠিক উল্টো, প্রয়োজনের কথাটিও বলতে চায় না, কম্পিউটার নিয়ে সে বিশেষ কিছু জানত না কিন্তু গত কয়েকদিনে সে এ ব্যাপারে মোটামুটি পারদর্শী হয়ে এসেছে। লাল চুলের মেয়েটি–যার নাম নাইনা, তার অসম্ভব একটা যান্ত্রিক দক্ষতা রয়েছে। যে কোনো যন্ত্রকে খুলে ফেলে সে চোখের পলকে জুড়ে দিতে পারে। গত কয়েকদিনে সে আমাদের জন্যে গোটা চারেক বাই ভার্বাল দাঁড় করিয়েছে। কয়েকটি প্রাচীন রবোটকেও যোগাড় করা হয়েছে, সে তার মাঝে কিছু পরিবর্তন করে আমাদের ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত করবে। একজন মানুষের মাঝে এ রকম প্রাণশক্তি আমি কখনো দেখি নি।
টিয়ারাকে দেখেও আমি অবাক হয়ে যাই, আমাদের কোনো চিকিৎসক রবোট নেই। কিন্তু টিয়ারা আশ্চর্য দক্ষতা নিয়ে আমাদের ছোটখাটো শারীরিক সমস্যার সমাধান করে ফেলছে। কয়েকদিন আগে একটা উঁচু দেয়াল থেকে পড়ে এলুজ তার হাত কনুইয়ের কাছে ভেঙে ফেলল, ক্রিশির এক্স–রে সংবেদন চোখ ব্যবহার করে সে কীভাবে কীভাবে জানি এলুজের হাতকে ঠিক করে দিল। এখনো সেটি বুকের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে কিন্তু বোঝ যাচ্ছে সেটি নিয়ে আর কোনো সমস্যা হবে না।
আমি নিজেকে দেখেও মাঝে মাঝে একটু অবাক হয়ে যাই। এতদিন আমি নিজেকে খুব সাধারণ একজন মানুষ বলে জানতাম কিন্তু গত কিছুদিন থেকে আমি নিজের একটা ক্ষমতা আবিষ্কার করছি। খুব কঠিন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে আমি তার অত্যন্ত বিচিত্র একটা সমাধান বের করে ফেলি। সবসময় সেটি কাজ করে সেটা সত্যি নয় কিন্তু যখন আর কিছুই করার থাকে না তখন সেইসব সমাধান হঠাৎ করে খুব আকর্ষণীয় মনে হতে থাকে।
দলের বেশিরভাগ সদস্যের সত্যিকার অর্থে কোনো দক্ষতা ছিল না, এখন অন্যদের সাথে পাশাপাশি কাজ করে সবাই কোনো–না–কোনো বিষয়ে মোটামুটি দক্ষ হয়ে উঠেছে। তাদেরকে জটিল একটি দায়িত্ব দেয়া যায় এবং তারা প্রায় সবসময়েই সাহায্য ছাড়াই সেইসব দায়িত্ব পালন করে ফেলে।