ভয় আমার নিজের জন্যে নয় রাইনুক।
তাহলে কার জন্যে?
তোমাদের জন্যে। এটি সত্যি সত্যি একটি বিশাল বিপজ্জনক অরণ্য। যাই হোক তোমরা নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত? এস বসে কিছু একটা খাওয়া যাক। ক্রিশি খুঁজে খুঁজে এক ধরনের পানীয় এনেছে, পদার্থটি কী আমরা জানি না কিন্তু খেতে চমৎকার।
আমরা সবাই আগুনকে ঘিরে লাল রঙের পানীয়টি চেখে খেতে থাকি। কয়েকজন মানুষের উপস্থিতিতেই জায়গাটি হঠাৎ কেমন যেন উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।
টিয়ারা ছোট কুকুরটিকে কোলে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। একটি কুকুর যে এত দ্রুত কোনো মানুষের ন্যাওটা হয়ে যেতে পারে, না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না!
আমি রাইনুকের সাথে কথা বলতে থাকি, আমাদের বসতির কে কেমন আছে খবরাখবর নিই। সব মন খারাপ করা খবর। লিয়ানা আমাকে চলে যেতে দিয়েছে বলে গ্রুস্টান তাকে সিলাকিত করেছে। মানুষকে সিলাকিত করা হলে তার শরীরটি সিলিকনের একটি সিলিন্ডারে রেখে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া হয়। গ্রুস্টান তখন মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে। সেই মানুষটিকে ইচ্ছে করলে যে কোনো ধরনের আনন্দ দিতে পারে আবার ইচ্ছে করলে অমানুষিক যন্ত্রণা দিতে পারে। সিলাকিত মানুষের প্রতিচ্ছবি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে দেখা সম্ভব। লিয়ানাকেও নাকি কয়েকবার দেখা গিয়েছে, অত্যন্ত বিষণ্ণ এবং দুঃখী চেহারায়। যদিও সবাই জানে এটি সত্যিকারের লিয়ানা নয় গ্রুস্টানের তৈরী একটি প্রতিচ্ছবি তবুও দেখে সবার খুব মন খারাপ হয়ে গেছে। গ্রুস্টান মনে হয় সেটাই চাইছিল তার অবাধ্য হবার শাস্তি কী হতে পারে তার একটা উদাহরণ দেখানো।
আমাদের বসতির বর্তমান অধিপতি হচ্ছে ক্ৰকো। রাইনুকের ধারণা, ক্ৰকো মানুষ এবং বৃক্ষের মাঝামাঝি একটি জীব। মেরুদণ্ডহীন ভীতু একটি কাপুরুষ। বসতির মানুষজনের মানসিক অবস্থা ভালো নয়। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে ষোলো বছরের ফুটফুটে একটি মেয়ে একটি টাওয়ারের উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। মৃত্যুর আগে লিখে গেছে এই জীবনকে দীর্ঘায়িত করার তার কোনো উৎসাহ নেই।
রাইনুকের কথা শুনে আমি হঠাৎ করে বুকের ভিতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি।
০৮. জায়গাটা মোটামুটি সমতল
আমরা যেখানে বসেছি জায়গাটা মোটামুটি সমতল। চারপাশে বড় বড় কংক্রিটের টুকরা পড়ে আছে। তার মাঝে কেউ হেলান দিয়ে বসেছে কেউ আবার পা ঝুলিয়ে বসেছে। সব মিলিয়ে এখানে চৌদ্দ জন মানুষ, তার মাঝে চার জন মেয়ে। যারা এসেছে তার মাঝে এক দুজন মধ্যবয়স্ক, অন্য সবাইকে মোটামুটি তরুণ–তরুণী হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায়।
আমি নিজে একটা ধাতব সিলিন্ডারের উপর বসে আছি। গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে একটা সংগ্রাম শুরু করেছি মনে করে সবাই এখানে এসেছে–পুরো ব্যাপারটি যে আসলে একটি বড় ধরনের ভুল বোঝাবুঝি আমি এইমাত্র সেটি সবাইকে খুলে বলেছি। শুধু তাই নয় আমি খোলাখুলিভাবে সবাইকে বলে দিয়েছি যে আমি একটা অত্যন্ত সাধারণ মানুষ, আমার মাঝে। নেতৃত্ব দেয়ার মতো কোনো শক্তি নেই। অন্যদের পথ দেখানো দূরে থাকুক আমি কোনোভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়েই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার কথা শুনে উপস্থিত সবার মুখে একটা গভীর আশাভঙ্গের ছাপ পড়বে। কিন্তু কারো মুখে আশাভঙ্গ বা হতাশার কোনো চিহ্ন দেখলাম না বরং সবাই এক ধরনের হাসিমুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, আমি কী বলতে চাইছি তোমরা মনে হয় ঠিক বুঝতে পার নি।
রাইনুক মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি, খুব ভালো করে বুঝেছি। তুমি যে এ রকম কথা বলবে আমরা আগে থেকে জানতাম।
আগে থেকে জানতে?
পিছনের দিকে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বলল, মহামান্য কুশান আমার নাম ইশি, আপনাকে–
আমি একটু উষ্ণস্বরে বললাম, আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ। আমি তোমাদের নেতা নই, আমাকে কৃত্রিম আনুষ্ঠানিক একটা সম্মান দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই–
ঠিক আছে আমি দেখাব না। ইশি নামের মানুষটি সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, কুশান। তোমাকে আমি একটা কথা বলি।
বল।
প্রাচীনকালে সেনাপতিরা যেরকম একটা সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে রাজ্য জয় করতে যেত আমরা তোমার কাছে সেরকম নেতৃত্ব আশা করছি না। কখনো করি নি।
তাহলে তোমরা কী আশা করছ?
আমরা তোমার কাছে যে নেতৃত্ব আশা করছি বলতে পার সেটা হচ্ছে একটা স্বপ্নের নেতৃত্ব, একটা বিশ্বাসের নেতৃত্ব। সত্যি কথা বলতে কী তোমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই নেতৃত্বটিও দেবার আর প্রয়োজন নেই। তার কারণ–
ইশি কী বলতে চাইছে আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। ইশি একটু হেসে বলল, তার কারণ তুমি ইতিমধ্যে সেটা আমাদের দিয়েছ। দীর্ঘদিন গ্রুস্টান আমাদের শাসন করেছে, তার কবলে থেকে থেকে আমাদের স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা চলে গিয়েছিল। তুমি আবার আমাদের স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছ। এখন আমরা আবার তোমাকে নিয়ে কাজ করতে চাই, তার বেশি কিছু নয়।
সবাই গম্ভীর মুখে সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকে। লাল চুলের একটি মেয়ে হাত দিয়ে তার কপালের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে বলল, কুশান তুমি নিজে হয়তো জান না কিন্তু তুমি দুটি খুব বড় বড় কাজ করেছ।