আমার খুব ইচ্ছে হল টিয়ারাকে নরম গলায় বলি, তুমি তোমার বসতিতে যেয়ো না, তুমি থাক আমার কাছাকাছি। আমি গ্রুস্টানকে ধ্বংস করে দেব
কিন্তু আমি সেটা বলতে পারলাম না, কারণ সেটি সত্যি নয়। পৃথিবীর কোনো মানুষ গ্রুস্টানকে ধ্বংস করতে পারবে না।
আমি শুয়ে শুয়ে শুনতে পেলাম টিয়ারা গুনগুন করে গান গাইছে। কী বিষণ্ণ করুণ একটি সুর, শুনে বুকের মাঝে কেমন জানি হাহাকার করতে থাকে। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে শুয়ে অনুভব করি হঠাৎ কেন জানি আমার চোখ ভিজে উঠছে। কিসের জন্যে?
.
ভোররাতে ক্রিশি আমাকে ডেকে তুলল। আমি ধড়মড় করে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে ক্রিশি?
দুজন মানুষ আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে মহামান্য কুশান।
দুজন মানুষ? আমি চাপা গলায় চিৎকার করে বললাম, মানুষ?
হা। এবং একটি প্রাণী।
প্রাণী?
হ্যাঁ চতুষ্পদ প্রাণী। সম্ভবত কুকুর।
আমার সাথে দেখা করতে এসেছে? কুকুর দেখা করতে এসেছে?
একটি কুকুর এবং দুজন মানুষ।
আমি তখনো পুরোপুরি জেগে উঠতে পারি নি। কোনোমতে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় তারা? কী চায়? কেন এসেছে? কেমন করে জানল আমি এখানে?
আমার গলার স্বরে টিয়ারাও জেগে উঠেছে, ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে কুশান?
ক্রিশি বলছে, দুজন মানুষ আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।
সর্বনাশ! কেন এসেছে?
মহামান্য কুশান এবং মহামান্য টিয়ারা, ব্যাপারটিতে ভয়ের কোনোই ব্যাপার নেই। যারা এসেছেন তারা বন্ধুভাবাপন্ন, তাদের থেকে কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই।
তুমি কেমন করে জান?
আমি একজনকে চিনি। তিনি আমাদের পুরোনো বসতিতে ছিলেন। তার নাম মহামান্য রাইনুক।
রাইনুক এসেছে? রাইনুক? আমি চিৎকার করে বললাম, তুমি এতক্ষণে বলছ? কোথায়?
এক্ষুনি এসে পড়বে। আমি আগে এসে আপনাকে খবর দিতে চেয়েছি–ওই যে তাদের দেখা যাচ্ছে।
আমি অবাক হয়ে দেখি সত্যি সত্যি রাইনুক এবং আরেকজন কমবয়সী মানুষ একটা ছোট কুকুরের গলার চেন ধরে তাকে টেনে রাখতে রাখতে এসে হাজির হল। কুকুরটি আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার ঘেউ ঘেউ করে ডেকে হঠাৎ ঠিক মানুষের মতো হাই তুলে হঠাৎ গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল। রাইনুক আমাকে দেখে প্রায় ছুটে আসে–আমরা একজন আরেকজনকে জাপটে জড়িয়ে ধরি, আমার মনে পড়ে না আমি আগে কখনো আমার। অনুভূতিকে কোনোদিন এভাবে প্রকাশ করেছি। খানিকক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তোমাকে খুব বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে কুশান! আমাদের সবার ধারণা ছিল তোমাকে আরো অনেক সতেজ দেখাবে!
আমি হাসিমুখে বললাম, তুমি সত্যিই বিশ্বাস কর আমি যেভাবে আছি সেখানে খুব সতেজ থাকা যায়?
রাইনুক বলল, কেন নয়? তুমি সতেজ থাকলেই আমরা সবাই সতেজ থাকব।
কেন? আমার সাথে তোমাদের কী সম্পর্ক?
রাইনুকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী মানুষটি বলল, কারণ আপনি গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমাদের নেতৃত্ব দেবেন।
আমি চমকে তার দিকে তাকালাম, কিছু একটা বলার আগেই হঠাৎ টিয়ারা খিলখিল করে হেসে ওঠে। কিছুতেই সে হাসি থামাতে পারে না। কমবয়সী মানুষটি একটু হকচকিয়ে যায়, টিয়ারার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই টিয়ারা। তুমি এমন করে হাসছ কেন?
টিয়ারা হাসতে হাসতে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কুশান, তুমি উত্তর দাও।
আমি মানুষটির দিকে তাকালাম, সে সাথে সাথে মাথা নত করে একটু অভিবাদনের ভঙ্গি করে বলল, আমার নাম এলুজ। আমি দক্ষিণের বসতি থেকে এসেছি। উত্তরের বসতি থেকে যারা আসছে তারা আর কিছুক্ষণের মাঝে পৌঁছে যাবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আরো মানুষ আসছে?
রাইনুক মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ আরো অনেকে আসছে। আমরা তোমার সঙ্কেতের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। যখন সঙ্কেত পেয়েছি সাথে সাথে রওনা দিয়েছি।
সঙ্কেত? আমি তোমাদের আসার জন্যে সঙ্কেত দিয়েছি?
হা। তুমি যখন টিয়ারাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলে ঠিক তখন আমরা বুঝতে পেরেছি গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে সগ্রাম করার জন্যে এখন তোমার আরো মানুষ দরকার। সাথে সাথে আমরা রওনা দিয়েছি।
আমি হতবাক হয়ে রাইনুকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শুনতে পেলাম টিয়ারা হঠাৎ আবার খিলখিল করে হাসতে শুরু করেছে। রাইনুক একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, টিয়ারা হাসছে কেন?
আমি কোনো কথা না বলে দুই পা পিছিয়ে ঐকটা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসি। টিয়ারা হাসি থামিয়ে বলল, কুশান তুমি ওদের বল আমি কেন হাসছি।
বলব! সবাই আসুক তখন বলব। তার আগে তোমাদের কাছে আমি একটা জিনিস জানতে চাই, গ্রুস্টান আমাকে খুঁজছে। তোমরা যদি এত সহজে আমাকে খুঁজে বের করতে পার গ্রুস্টানের রবোট কেন পারছে না?
এলুজ নামের কমবয়সী মানুষটি একগাল হেসে বলল, কখনো পারবে না। আমরা এসেছি একটা অভিনব উপায়ে।
কী উপায়ে?
একটা প্রাচীন বইয়ে পড়েছিলাম কুকুরের ঘ্রাণশক্তি খুব প্রবল। আমাদের বসতিতে একটি কুকুর রয়েছে, কীভাবে তাকে রাখা হয়েছে সেটি আরেক ইতিহাস। যাই হোক রাইনুক আপনার ঘর থেকে আপনার ব্যবহারী কিছু কাপড় নিয়ে এসেছে। কুকুরটি তার ঘ্রাণ থেকে আপনি কোন পথে গিয়েছেন সেটি খুঁজে বের করেছে। কোনো রবোটের পক্ষে সেটি সম্ভব নয়।
কিন্তু তোমরা বলেছ আরো অনেক মানুষ আসবে—
রাইনুক বলল, আমরা আশপাশের বসতির মানুষেরা একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ রেখেছি। যখন তোমার সাথে যোগাযোগ করার জন্যে রওনা দিয়েছি আমরা পথে পথে একজন একজন করে রেখে এসেছি। তারা একজন আরেকজনকে পথ দেখিয়ে আনবে। তোমার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।