আমি যতক্ষণ কথা বলছিলাম টিয়ারা আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে ছিল, আমার কোনো কথা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হল না। আমি আবার রেগে উঠে বললাম, তুমি ওরকম করে হাসছ কেন?
টিয়ারা হাসতে হাসতে বলল, কে বলল আমি হাসছি? আমি মোটেও হাসছি না।
আমি হাল ছেড়ে দিলাম। শুনলাম আগুনের অন্য পাশে বসে ক্রিশি বিড়বিড় করে বলল, মানুষ অত্যন্ত দুর্বোধ্য প্রাণী।
আমি আরেক টুকরা ছোট বিস্ফোরক আগুনের দিকে ছুঁড়ে দিতেই আবার আগুনের শিখা লাফিয়ে অনেক উপরে উঠে গেল। অন্ধকার রাতে এই আগুনের শিখাটিকে দেখে মনে হয় যেন জীবন্ত কোনো প্রাণী কোনো এক ধরনের বিচিত্র উল্লাসে নাচছে। আমি আগুনের দিকে তাকিয়েছিলাম তখন টিয়ারা আবার আমাকে ডাকল, কুশান।
বল।
আমি তোমাকে একটা কথা বলব?
বল।
তুমি সত্যিই হয়তো গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মানুষকে মুক্ত করতে চাও না–কিন্তু তাতে এখন আর কিছু আসে যায় না।
তুমি কী বলতে চাইছ?
অনেক মানুষ যখন একটা জিনিস বিশ্বাস করে, সেটা যদি ভুল জিনিসও হয়, তাহলে সেটাই সত্যি হয়ে যায়। মানুষ বিশ্বাস করে তুমি গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, সেটা মানুষকে এত আশ্চর্য একটা স্বপ্ন দেখিয়েছে যে
টিয়ারা হঠাৎ থেমে গেল। আমি একটু অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, যে কী?
এখন মানুষের মুখ চেয়ে তোমার গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।
তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি মাথা নেড়ে বললাম, গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সহজ
তুমি হয়তো চাও নি, কিন্তু তুমি যুদ্ধ শুরু করেছ। তুমি প্রথমবার সবাইকে বলেছ গ্রুস্টান একটা তুচ্ছ অপারেটিং সিস্টেম—সবাই চমকে উঠেছে, শুনে ভয় পেয়েছে, কিন্তু কেউ মাথা থেকে সেটা সরাতে পারছে না গ্রুস্টানের মাঝে আগে একটা ঈশ্বর ঈশ্বর ভাব ছিল সেটা আর নেই। তাকে দেখে সবাই এখন ভাবে এটি একটি অপারেটিং সিস্টেম
কিন্তু ভয়ঙ্কর শক্তিশালী অপারেটিং সিস্টেম।
টিয়ারা কেমন জানি জোর দিয়ে বলল, তাতে কিছু আসে যায় না। সে এক সময় ধরাছোঁয়ার বাইরের অতিমানবিক অলৌকিক একটা শক্তি ছিল, এখন সে তুচ্ছ অপারেটিং সিস্টেম। রিকিভ ভাষায় লেখা একটা পরিব্যাপ্ত অপারেটিং সিস্টেম! এখন সে আঘাত করার পর্যায়ে নেমে এসেছে। এখন তোমাকে আঘাত করতে হবে–
আমি?
টিয়ারা স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ তুমি!
কেমন করে আমি আঘাত করব? কোথায়?
আমি জানি না কোথায়, কিন্তু আমি জানি তুমি পারবে। তোমার সেই ক্ষমতা আছে।
তুমি কেমন করে জান?
আমি দেখেছি! তুমি আমার চোখের সামনে একটি অসম্ভব কাজ করেছ। ছয়টি ভয়ঙ্কর রবোটকে ধ্বংস করেছ। তুমি আবার একটি অসম্ভব কাজ করবে।
আমি হাল ছেড়ে দিলাম। একজন মানুষ যে কী পরিমাণ অযৌক্তিক একটা জিনিস বিশ্বাস করতে পারে সেটি আমি এখন নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। আমি আরেকটা ছোট বিস্ফোরক আগুনের মাঝে ছুঁড়ে দিচ্ছিলাম তখন টিয়ারা আবার ডাকল, কুশান।
বল।
তুমি মানুষকে যত সুন্দর করে স্বপ্ন দেখাতে পার আর কেউ সেটা পারে না।
আমি কখন স্বপ্ন দেখালাম?
আজ সকালে তুমি কী বলেছিলে মনে আছে?
কী বলেছি?
বলেছ একটি শিশুর জন্ম হবে একজন ছেলে আর একজন মেয়ের ভালবাসা থেকে। টিয়ারা আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে খপ করে আমার হাত ধরে বলল, তুমি জান এর অর্থ কী? তুমি জান?
আমি চুপ করে রইলাম, টিয়ারা ফিসফিস করে বলল, তার অর্থ আমরা আবার সত্যিকারের মানুষ হব। আমাদের আপনজন থাকবে, ভালবাসার মানুষ থাকবে, সন্তান থাকবে–ভ্রূণ ব্যাংক থেকে পাওয়া শিশু নয়, সত্যিকারের সন্তান। নিজের রক্তমাংসে তৈরী সন্তান।
আগুনের আভায় টিয়ারার মুখ জ্বলজ্বল করতে থাকে, আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। একটি সন্তানকে বুকে ধরার জন্যে একটি মেয়ে কত ব্যাকুল হতে পারে আমি এর আগে কখনো বুঝতে পারি নি।
আমি শুনতে পেলাম আগুনের অন্য পাশে বসে থেকে ক্রিশি বিড়বিড় করে বলল, মানুষ একটি অত্যন্ত বিচিত্র প্রাণী। অত্যন্ত বিচিত্র।
রাত্রিবেলা আগুনের দুই পাশে আমি আর টিয়ারা বয়ে আছি, মাঝে মাঝে আগুনের লাল আভায় তার মুখ স্পষ্ট হয়ে আসে। আমি তার দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতর এক ধরনের আলোড়ন অনুভব করি। বিচিত্র এক ধরনের আলোড়ন। আমি আগে কখনো এ রকম অনুভব করি নি। একই সাথে দুঃখ এবং সুখের অনুভূতি। একই সাথে কষ্ট এবং আনন্দ, হতাশা এবং স্বপ্ন। জোর করে আমি আমার মনোযোগ সরিয়ে আনি। মানুষের পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে, যেটা রয়েছে সেটা একটা ধ্বংসস্তূপ। এখানে স্বপ্নের কোনো স্থান নেই। এটি দুর্যোগের সময়, এখানে এখন রূঢ় নিষ্ঠুরতা, বেঁচে থাকার জন্যে এক ধরনের নৃশংস প্রতিযোগিতা। এখন বুকের মাঝে কোনো স্বপ্নের স্থান দিতে হয় না। আমি খানিকক্ষণ একদৃষ্টে টিয়ারার দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে ডাকলাম, টিয়ারা—
বল।
তুমি এখন কী করবে?
টিয়ারা দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, আমি সম্ভবত আমার বসতিতে ফিরে যাব। ফিরে গিয়ে
ফিরে গিয়ে?
ফিরে গিয়ে গ্রুস্টানের প্রিয় মানুষটিকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিব। হয়তো কোনো একদিন ভ্রূণ ব্যাংক থেকে আমাকে একটা শিশু দেবে। হয়তো
হয়তো কী?
টিয়ারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না কিছু না।