আমি তখনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না যে সত্যিই রবোটগুলোকে ধ্বংস করে ফেলেছি। একটি নয় দুটি নয় ছয় ছয়টি ভয়ঙ্কর নৃশংস রবোট আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমি আর নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না, সেখানে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লাম। আমার সমস্ত শরীর ঘামছে কুলকুল করে, হাত কাঁপছে, কিছুতেই থামাতে পারছি না। হঠাৎ করে আমার সমস্ত শরীর কেমন যেন গুলিয়ে আসে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে নিতেই আমার হাতে সাদা রং উঠে এল। কী আশ্চর্য! সত্যিই? তাহলে আমি টিয়ারাকে রক্ষা করে ফেলেছি–ঠিক যেরকম তাকে কথা দিয়েছিলাম!
টিয়ারা হেঁটে হেঁটে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। আমার দিকে তখনো বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, রবোটগুলো নিজেদের যত বুদ্ধিমান ভেবেছিল আসলে তত বুদ্ধিমান নয়! কী বল?
তুমি–তুমি–তুমি কেমন করে করলে?
জানি না! কখনো ভাবি নি ফন্দিটা কাজ করবে। হয়তো সত্যিই ভাগ্য বলে কিছু আছে।
ঠিক তখন ক্রিশি হেঁটে আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে। বললাম, ক্রিশি! তুমি বলেছিলে আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতকরা দশমিক শূন্য শূন্য সাত। এখন কী বলবে?
আমার হিসেবে তাই ছিল।
তোমার হিসেব খুব ভালো বলা যায় না!
আমার হিসেব সাধারণত যথেষ্ট ভালো। কিন্তু ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে মানুষ হঠাৎ করে বিচিত্র যেসব সমাধান বের করে ফেলে আমার সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।
থাকার কথা না। আমার নিজেরও নেই। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ক্রিশি এখন তোমার কয়েকটা কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
প্রথমত আমার আর টিয়ারার ট্রাকিওশান দুটি খুলে বা বের করে আন। তারপর খুঁজে খুঁজে খানিকটা ওষুধ বের করে আন যেন আমার হাতের এই বিচ্ছিরি ঘা–টা শুকানো যায়। সবশেষে সারা দুনিয়া খুঁজে যেখান থেকে পার চমৎকার কিছু খাবার আর পানীয় নিয়ে এস– আজ আমি টিয়ারার সম্মানে একটা ভোজ দিতে চাই।
আমার সম্মানে? টিয়ারা হেসে বলল, কেন?
কারণ আজ ভোরে আমার আত্মহত্যা করার কথা ছিল। তুমি এসেছিলে বলে করা হয় নি! আক্ষরিক অর্থে তুমি আমাকে আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছ।
টিয়ারা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। তার সেই দৃষ্টিতে হঠাৎ আমার বুকের ভিতর সবকিছু কেমন যেন ওলটপালট হয়ে যায়।
০৭. সন্ধেবেলা একটা ঘোট আগুন জ্বালিয়ে
সন্ধেবেলা একটা ঘোট আগুন জ্বালিয়ে আমি আর টিয়ারা বসে আছি। ক্রিশি বসেছে আগুনের অন্য পাশে। সে যদি মানুষ হত তার মুখে একটা বিরক্তির ছায়া থাকত কোনো সন্দেহ নেই। হাতের কাছে একটা জিনন ল্যাম্প থাকার পরেও আগুন জ্বালানোর সে ঘোরতর বিরোধী। আমি আগুনে একটা দ্বিতীয় মাত্রার বিস্ফোরক ছুঁড়ে দিতেই একটা ছোট বিস্ফোরণ করে আগুনটা লাফিয়ে অনেকদূর উঠে গেল। ক্রিশি বিড়বিড় করে বলল, সম্পূর্ণ অর্থহীন একটি বিপজ্জনক কাজ।
আমি হাসি চেপে বললাম, আগুনকে গালি দিও না ক্রিশি। আগুন থেকে সভ্যতার শুরু।
তুমি যেটা করছ সেটা আগুন নয়, সেটা বিস্ফোরণ। আগুনকে চেষ্টা করে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, বিস্ফোরণকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। বিস্ফোরণ অত্যন্ত বিপজ্জনক।
আমি আরেকটি ছোট বিস্ফোরক আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে হেসে বললাম, কী করব আমি, আজকে শুধু বিপজ্জনক কাজ করার ইচ্ছে করছে।
টিয়ারা নরম গলায় বলল, তুমি আজ সকালে যে কাজটি করেছ তার তুলনায় যে কোনো কাজকে ছেলেখেলা বলা যায়।
আমি ক্রিশিকে বললাম, এই দেখ, টিয়ারাও বলছে এটা ছেলেখেলা।
ক্রিশি মাথা নেড়ে বলল, মানুষ একটি দুর্বোধ্য প্রাণী।
খাঁটি কথা, আমি হাসতে হাসতে বলি, একেবারে খাঁটি কথা।
টিয়ারা খানিকক্ষণ আগুনের দিকে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে ঘুরে বলল, তুমি কি এখন গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে তোমার যুদ্ধ শুরু করবে?
আমি অবাক হয়ে টিয়ারার দিকে তাকালাম, তার মুখে আগুনের লাল আভা, মুখে হাসির চিহ্ন নেই। সে কৌতুক করে বলছে না, সত্যি সত্যি জানতে চাইছে। আমি অবিশ্বাসের গলায় বললাম, কী বলছ তুমি? আমি কেন গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব?
তাহলে কে করবে?
আমি অবাক হয়ে বললাম, কাউকে করতে হবে কে বলেছে?
তুমি বলেছ।
আমি বলেছি? আমি কখন বললাম?
টিয়ারা মাথা নেড়ে বলল, আমি জানিনা তুমি কখন বলেছ কিন্তু সবাই জানে। তোমার সম্পর্কে অনেক রকম গল্প আছে।
কী গল্প?
তুমি সাহসী আর তেজস্বী। তুমি মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাব। তুমি গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে লড়বে, মানুষকে মুক্ত করবে এইসব গল্প।
আমি এবারে কেন জানি একটু রেগে উঠলাম, গলা উঁচিয়ে বললাম, তুমি তো জান এইসব মিথ্যা।
টিয়ারা হেসে ফেলল, হাসলে এই মেয়েটিকে এত সুন্দর দেখায় যে নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না। হাসতে হাসতেই বলল, না আমি জানি না।
ঠিক আছে, তুমি যদি না জেনে থাক তোমাকে এখন বলছি শুনে রাখ। আমি খুব সাধারণ মানুষ, অত্যন্ত সাধারণ। শুধু সাধারণ নয় আমি মনে হয় একটু বোকা–না হলে কিছুতেই এ রকম একটা অবস্থায় এসে পড়তাম না। শুধু তাই নয় আমি ভীতু এবং কাপুরুষ। এই রবোটদের হাত থেকে বাঁচার জন্য আত্মহত্যা করব বলে ঠিক করেছিলাম। আমার গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই, কখনো ছিলও না।