কোথায়?
মনে নেই আজ গ্রুস্টান দেখা দেবে?
কিন্তু সে তো মাঝরাতে।
একটু আগে যদি না যাই বসার জায়গা পাব না।
তাই বলে এত আগে?
এত আগে কোথায় দেখলে? রাইনুক মাথা নেড়ে বলল, খাবারের ঘর থেকে খাবার তুলে নিতে দেখবে কত সময় চলে যাবে। চল যাই।
আমি আর কিছু বললাম না। রাইনুকের সাথে কোনোকিছু নিয়ে তর্ক করা যায় না। সে অল্পতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, সবকিছুকে সে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে নেয়। পৃথিবী যদি এভাবে ধ্বংস না হয়ে যেত সে নিশ্চয়ই খুব বড় একটি প্রতিষ্ঠানে খুব দায়িত্বশীল একজন মানুষ হত। অনেক বড় বিজ্ঞানী বা ইঞ্জিনিয়ার। রকেট বিশেষজ্ঞ বা মহাকাশচারী। কিন্তু এখন সে আর কিছুই হতে পারবে না, ধ্বংসস্তূপের আড়ালে আড়ালে সে বেঁচে থাকবে। ধসে পড়া বারোয়ারী খাবারের ঘরে বিস্বাদ খাবারের জন্যে হাতাহাতি করবে। বিবর্ণ কাপড় পরে ঘুরে বেড়াবে। প্রাচীন নির্বোধ রবোটের সাথে অর্থহীন তর্ক করে অনুজ্জ্বল টার্মিনালের সামনে বসে থেকে বিষাক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে নিতে একদিন সে নিঃশেষ হয়ে যাবে। যেভাবে আরো অনেকে নিঃশেষ হয়েছে।
আমি আর রাইনুক পাশাপাশি হাঁটছি হঠাৎ সে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, কুশান–
কী?
তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?
কর।
তোমার কি মনে হয় না আমাদের জীবনের কোনো অর্থ নেই?
রাইনুকের গলার স্বরে এক ধরনের হাহাকার ছিল যেটি হঠাৎ আমার হৃদয়কে স্পর্শ করে, তার জন্যে হঠাৎ আমার বিচিত্র এক ধরনের করুণা হতে থাকে। আমি কোমল গলায় বললাম, না রাইনুক, সেটা সত্যি নয়।
কেন নয়?
একজন মানুষের যখন কিছু করার থাকে না তখন তার জীবন অর্থহীন হয়ে যায়। আমাদের তো এখন অনেক কিছু করার আছে।
কী করার আছে?
বেঁচে থাকার জন্যে কত কী করতে হয় আমাদের প্রতি মুহূর্তে একটা করে নূতন পরীক্ষা, একটা করে নূতন যুদ্ধ!
এটাকে তুমি জীবন বল?
জীবন বড় আপেক্ষিক। তার কোনো চরম অবস্থান নেই। তুমি এই জীবনকে যেভাবে দেখবে সেটাই হবে তার অবস্থান।
রাইনুক কোনো কথা না বলে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, অন্ধকারে আমি তার চোখ দেখতে পেলাম না কিন্তু আমি জানি তার দৃষ্টি ক্রুদ্ধ!
.
খাবারের ঘরটিতে খুব ভিড়। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে সবাই ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে, একটি প্রতিরক্ষা রবোট স্ক্যানার হাতে নিয়ে মিছেই ছুটোছুটি করে রেটিনা স্ক্যান করে সবার পরিচয় নির্দিষ্ট করার চেষ্টা করছিল। ভিতরে খাবার পরিবেশনকারী রবোটগুলো খাবারের ট্রে নিয়ে অর্থহীনভাবে ছুটোছুটি করছে, ট্রের উপরে গাঢ় বাদামি রঙের চতুষ্কোণ বিস্বাদ খাবার।
দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে আমরা ভিতরে ঢুকে নিজের অংশের খাবারটুকু প্লেটে তুলে নিই। একটি ছোট বোতলে করে একটি রবোট আমাদের খানিকটা লাল রঙের তরল ধরিয়ে দিল, ভিতরে কী আছে কেউ জানে না, দীর্ঘদিন থেকে তবুও আমরা সেটা বিশ্বাস করে খেয়ে আসছি। ঘরের ভিতরে ভাপসা গরম, বসার জায়গা নেই। খাবারের ট্রে নিয়ে আমরা ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করতে থাকি। কী অকিঞ্চিৎকর খাবার আর কী মন খারাপ করা পরিবেশ! শরীরের জন্যে পুষ্টিকর! তা না হলে মানুষ কেমন করে এই খাবার দিনের পর দিন খেয়ে যেতে পারে? রবোট হয়ে কেন জন্ম হয় নি ভেবে মাঝে মাঝে দুঃখ হয়। তাহলে কানের নিচে একটা সৌর ব্যাটারি লাগিয়ে খাবারের কথা ভুলে যেতে পারতাম। কিন্তু আমার রবোট হয়ে জন্ম হয় নি তাই মাঝে মাঝেই আমার খুব ইচ্ছে করে একটা হ্রদের পাশে বসে আগুনে ঝলসিয়ে একটি তিতির পাখি খেতে, সাথে যবের রুটি আর আঙুরের রস! আমি কখনো এসব খাই নি, প্রাচীন গ্রন্থে এর উল্লেখ দেখেছি, ডাটাবেসে ছবি রয়েছে, মনে হয় নিশ্চয়ই খুব উপাদেয় খাবার হবে।
লাল রঙের পানীয়টুকু ঢক ঢক করে খেয়ে আমি আর রাইনুক খাবারের টুকরো দুটি হাতে নিয়ে বের হয়ে আসি। বাইরে অন্ধকার, স্থানে স্থানে ছোট ছোট সৌর সেল দিয়ে খানিকটা জায়গা আলোকিত করে রাখা আছে, খুব লাভ হয়েছে মনে হয় না। বরং মনে হয় তার আশপাশে অন্ধকার যেন আরো জমাট বেঁধে আছে। যদি কোনো আলো না থাকত তাহলে সম্ভবত অন্ধকারে আমাদের চোখ সয়ে আসত, আমরা আরো স্পষ্ট দেখতে পারতাম। কিন্তু মানুষ মনে হয় অন্ধকারকে সহ্য করতে পারে না, যত অল্পই হোক তাদের একটু আলো দরকার। দুর্ভাগ্যক্রমে মানুষের রবোটের মতো অবলাল সংবেদী চোখ নেই।
গ্রুস্টান আমাদের দেখা দেবার জন্যে শহরের মাঝামাঝি প্রাচীন হলঘরটি বেছে নিয়েছে। হলঘরের এক অংশ খুব খারাপভাবে ধসে যাবার পরও সামনের অংশটুকু মোটামুটি অবিকৃতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে এই হলঘরটিতে দুই থেকে তিন হাজার মানুষ বসতে পারত, এখন সেটি সম্ভব নয়–তার প্রয়োজনও নেই। আমাদের এই বসতিতে সব মিলিয়ে তেষট্টি জন মানুষ, যার মাঝে বেশিরভাগই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং অনেকগুলো রবোট। পারমাণবিক ব্যাটারির অভাব বলে বেশিরভাগ রবোটকেই অচল করে রাখা আছে, নেহাত প্রয়োজন না হলে সেগুলো চালু করা হয় না।
প্রাচীন হলঘরটিতে এর মাঝেই লোকজন আসতে শুরু করেছে। বসার জন্যে কোনো আসন নেই, শক্ত পাথরের মেঝেতে পা মুড়ে বসতে হয়। সামনে একটি লাল কার্পেট বিছিয়ে। রাখা হয়েছে; বাম পাশে একটি যোগাযোগ মডিউল, ডান পাশে প্লাটিনামের একটি পাত্রে গাঢ় সবুজ রঙের এক ধরনের পানীয়। এটি লিয়ানার জন্যে নির্ধারিত জায়গা, সে এই বসতির তেষট্টি জন মানুষ এবং কয়েক শতাধিক সচল ও অচল রবোটের দলনেত্রী। সে এখনো আসে নি। তার জন্যে জায়গা আলাদা করে রাখা হয় তাই আগে থেকে এসে অপেক্ষা করার কোনো প্রয়োজনও নেই।