গভীর রাতে হঠাৎ রবোটগুলো একটি মানুষের লোকালয় আক্রমণ করতে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। গত কয়েক দিন থেকে তারা একটু বিচিত্র ব্যবহার করছিল এবং তাদের ভাবভঙ্গি দেখে আমি বুঝতে পারি এবারে তারা বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের লোকালয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্যটি কী আমি বুঝতে পারলাম না। রওনা দেবার আগে হঠাৎ করে বাহাত্তর আমার কাছে এসে বলল, তোমাকে এবার আমাদের সাথে যেতে হবে না। মানুষ প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা বাড়িয়ে দিচ্ছে, তোমার ক্ষতি হতে পারে।
কিন্তু ট্রাকিওশান? আমি ট্রাকিওশানের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারি না।
কয়েক ঘণ্টার জন্যে ট্রাকিওশানের নিয়ন্ত্রণ দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছি, আশা করছি নিজের স্বার্থেই কোনো ধরনের অর্থহীন নির্বুদ্ধিতা করবে না।
আমি কোনো কথা বললাম না, কোনোকিছুতেই এখন আর কিছু আসে যায় না।
জীবনের শেষ মুহূর্তে নির্বোধ কিছু রবোটের পিছু পিছু একটি দস্যুবৃত্তিতে সহযোগিতা করতে হবে না জেনে কেমন জানি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ অনুভব করতে থাকি। তারা কখন ফিরে আসবে জানি না–কিন্তু আর আমার এদের মুখোমুখি হতে হবে না। এরা ফিরে আসার আগে আমি আমার জীবনটিকে শেষ করে দেব।
রবোটগুলো চলে যাবার পর আমি বহুদিন পর এক ধরনের অপূর্ব শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি একটি নীল হ্রদের। বিশাল হ্রদ তার মাঝে আশ্চর্য নীল পানি টলটল করছে। হ্রদের মাঝখানে একটি দ্বীপ। সেই দ্বীপে সবুজ গাছ। সত্যিকারের গাছ। সেই গাছে সত্যিকার পাতা। গাছের ডালে বসে আছে লাল ঠোঁটের অপূর্ব একঝাক পাখি। আমি একবার হাত তুলতেই সেই একঝাক পাখি গাছ থেকে উড়ে গেল আকাশে। আকাশে সাদা মেঘ, তার মাঝে পাখি উড়ছে। উড়তে উড়তে গান গাইছে পাখি। কী অপূর্ব সেই গান!
খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার কেটে যাচ্ছে হালকা আলো চারদিকে। এই সময়টার নিশ্চয়ই একটা জাদু রয়েছে। কুৎসিত ধ্বংসস্তূপটিও এখন কেমন জানি মায়াময় মনে হচ্ছে। আমি উঠে বসি। রবোটগুলো কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে আসবে। আর অপেক্ষা করা ঠিক নয়। আমি কোমল স্বরে ডাকলাম, ক্রিশি–
ক্রিশি এগিয়ে এল, বলুন মহামান্য কুশান।
আমার মনে হয় আত্মহত্যা করার জন্য এটাই ঠিক সময়।
আমারও তাই ধারণা। রবোটগুলো ফিরে আসতে শুরু করেছে। ঘণ্টা দুয়েকের মাঝে পৌঁছে যাবে। মেয়েটিকে নিয়ে একটু যন্ত্রণা হচ্ছে, না হয় আরো আগে ফিরে আসত।
মেয়েটি? আমি অবাক হয়ে বললাম, কোন মেয়েটি?
রবোটগুলো একটা মেয়েকে ধরে আনতে গিয়েছিল মহামান্য কুশান। তারা বিনোদনের যে সফটওয়ার পেয়েছে সেখানে পুরুষ ও রমণীর মাঝে জৈবিক সম্ভোগের ব্যাপার রয়েছে। রবোটগুলো সেটা একটা মেয়ের উপরে পরীক্ষা করে দেখতে চায়।
আমি বিস্তারিত চোখে ক্রিশির দিকে তাকালাম, কী বলছ তুমি?
আমি সত্যি কথা বলছি। তারা নিজেদের কপোট্রনে খানিকটা পরিবর্তন করেছে। আমার মনে হয় এখন তাদের ভিতরে নিম্ন শ্রেণীর যৌনচেতনা আছে। ব্যাপারটি কী সে সম্পর্কে আমার অবশ্যি কোনো ধারণা নেই।
আমি বুঝতে পারছি আমার ভিতরে যে কোমল শান্ত একটা ভাব এসেছিল সেটা দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে সেখানে প্রচণ্ড একটা ক্রোধের জন্ম নিচ্ছে। ধারালো চাকুটা হাতে নিয়ে আমি বসে রইলাম, হাতের ধমনীটি কেটে দেয়ার সহজ কাজটি করতে গিয়েও আমি করতে পারলাম না। মৃত্যুর আগে দুর্ভাগা মেয়েটির সাথে মনে হয় আমার অন্তত একবার কথা বলা দরকার।
বাহাত্তরের দলটি যখন পৌঁছেছে তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। যে মেয়েটিকে তারা ধরে এনেছে সে অল্পবয়সী। তাকে আমি যেরকম আতঙ্কগ্রস্ত দেখব বলে ভেবেছিলাম সেরকম দেখলাম না, মনে হল কেমন যেন হতচকিত হয়ে আছে। আমাকে দেখে সে একরকম ছুটে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কুশান?
আমি মেয়েটিকে ভালো করে লক্ষ করলাম, তার মাথায় ঘন কালো চুল এবং চোখ দুটিও আশ্চর্য রকম কালো। তার শরীরটি অসম্ভব কোমল, আমি এর আগে এত লাবণ্যময় কোনো মেয়ে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মেয়েটির গলায় রঙিন পাথরের একটি মালা। কাপড়ের সাথে এই রঙিন মালাটিতে তাকে একটি প্রাচীন তৈলচিত্রের চরিত্র বলে মনে হতে থাকে।
মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কুশান?
আমি তার গলায় এক ধরনের উত্তাপ অনুভব করি। মেয়েটি কেন আমার ওপর রাগ করছে আমি তখন বুঝতে পারি নি। আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, আমি কুশান।
তুমি কেন এভাবে আমাকে ধরে এনেছ?
মেয়েটির কথা শুনে আমি একেবারে হতচকিত হয়ে গেলাম। সে সত্যিই ভাবছে আমি রবোটগুলোকে পাঠিয়ে তাকে ধরে এনেছি? সেটা সত্যি সম্ভব? আমি অবাক হয়ে ক্রিশির দিকে তাকাতেই ক্রিশি মাথা নেড়ে বলল, লোকালয়ের মানুষেরা বিশ্বাস করে আপনি গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে সংঘবদ্ধ হচ্ছেন। রবোটগুলো আপনার অনুগত। আপনার আদেশে তারা কম্পিউটার ঘাটি ধ্বংস করছে গ্রুস্টানের ক্ষমতা কমানোর জন্যে। অনেক মানুষ সে জন্যে আপনাকে শ্রদ্ধা করে
আমি ধড়মড় করে উঠে বসি,কী বলছ তুমি?
ক্রিশি মাথা নাড়ল, আমি সত্যি কথা বলছি।
মানুষের বসতিতে আপনার সম্পর্কে অনেক রকম গল্প প্রচলিত আছে। আমি কমিউনিকেশান মডিউলে শুনেছি।
মেয়েটি খুব কৌতূহল নিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। আমি দেখতে পাই তার মুখে ক্রোধের চিহ্নটি সরে গিয়ে সেখানে চাপা বিস্ময় এবং এক ধরনের আতঙ্ক এসে উঁকি দিতে শুরু করেছে। আমার দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই রবোটদের নেতা নও?