আমি জানি। আমি এটা ব্যবহার করেছি। এর মাঝে একটা ত্রুটি আছে।
ক্রটি?
হ্যাঁ। শেষ পর্যায়ে যদি যেতে পার ব্ল্যাকহোলে বিলীন হয়ে যাবার আগের মুহূর্তে একটা রঙিন টুপি পরা ক্লাউন বের হয়ে আসে।
ক্লাউন?
হা। সেটা খিকখিক করে হাসতে থাকে, তখন যদি তার পিছু পিছু যাও সবকিছু গোলমাল হয়ে যায়। একটু অপেক্ষা করলে ক্লাউন অদৃশ্য হয়ে আবার ব্ল্যাকহোল ফিরে আসে।
অত্যন্ত বিচিত্র এবং অর্থহীন। কুরু মাথা নেড়ে বলল, ব্ল্যাকহোলের সাথে ক্লাউনের কোনো সম্পর্ক নেই।
অন্য রবোটগুলো কুরুর সাথে সাথে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, অর্থহীন। একেবারেই অর্থহীন।
বাহাত্তর আরেকটা ক্রিস্টাল হাতে নিয়ে বলল এই যে, আরেকটা নবম মাত্রার সফটওয়ার। এর নাম পঙ্কিল কুসুম।
পঙ্কিল কুসুম! আমি অবাক হয়ে বললাম তোমরা পঙ্কিল কুসুম পেয়েছ?
কেন, কী হয়েছে?
এটা দীর্ঘদিন বেআইনি ছিল। গ্রুস্টান কিছুদিন আগে মানুষকে ব্যবহার করতে দিয়েছে।
এটা কী রকম?
খুব যত্ন করে তৈরি করা সফ্টওয়ার। কিন্তু তোমরা ব্যবহার করতে পারবে না।
বাহাত্তর হঠাৎ তার ভীষণদর্শন অস্ত্রটি আমার দিকে তাক করে বলল, আমাদের বুদ্ধিমত্তার ওপর কটাক্ষ করে আর একটা কথা বললে তোমার ঘিলু বের করে দেব।
রবোটটির কথা আমার কাছে কেন জানি ফাঁপা বুলির মতো মনে হয়। আমি মাটিতে থুতু ফেলে বললাম, আমাকে মেরে ফেলার হলে অনেক আগেই মারতে। খামাখা ভয় দেখিও না। তোমার ওই অস্ত্রকে আমি ভয় পাই না।
বাহাত্তর স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তার দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বললাম, পঙ্কিল কুসুম একটি জৈবিক সফটওয়ার। ভালবাসার কারণে পুরুষ আর রমণীর ভিতরে যেসব জৈবিক প্রক্রিয়া হয় এটি সেটার ওপরে তৈরী। তোমরা নিম্ন শ্রেণীর রবোট। তোমাদের মাঝে ভালবাসা নেই জৈবিক অনুভূতিও নেই। তোমরা এটা বুঝবে না।
রবোটগুলো কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমাকে গুলি করে মেরে ফেলার একটা ছোট সম্ভাবনা রয়েছে, আমি তার জন্যে মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম, কিন্তু রবোটগুলো আমাকে মারল না। মরে যাওয়া নিয়ে আজীবন আমার ভিতরে যে এক ধরনের আতঙ্ক ছিল ইদানীং সেটি আর নেই।
আমি যেভাবে বেঁচে আছি তার সাথে মরে যাওয়ার খুব বেশি পার্থক্য নেই।
০৫. বিধ্বস্ত ঘরে জঞ্জালের মাঝে
দুদিন পর আমি একটি বিধ্বস্ত ঘরে জঞ্জালের মাঝে বসে ছিলাম। আমার পরনের কাপড় শতচ্ছিন্ন। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। আমার শরীর নোংরা, হাতে যেখানে ফুটো করে ট্রাকিওশান ঢুকিয়েছে সেখানে বিষাক্ত দগদগে ঘা। কয়েকদিন থেকে অত্যন্ত বিস্বাদ কিছু খাবার খেয়ে আছি, কেন জানি সেই খাবারের ওপর থেকে রুচি পুরোপুরি উঠে গেছে। কোনো একটি বিচিত্র কারণে হঠাৎ করে খুব গরম পড়েছে, বাতাসে জলীয় বাষ্প বলতে গেলে নেই, শুকনো ধুলা হু–হুঁ করে বইছে। চারদিকে এক ধরনের পোড়া গন্ধ, কোনো এক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস রয়েছে আশপাশে, আমার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা।
ক্রিশি আমার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি অনেকটা স্বগতোক্তির মতো করে বললাম, আর তো পারি না ক্রিশি। বড় কষ্ট!
ক্রিশি শান্ত গলায় বলল, মহামান্য কুশান, আমার ধারণা আপনার এই কষ্ট সহ্য করার পিছনে কোনো যুক্তি নেই।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তুমি আমাকে কী করতে বল?
আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য দুই। এই অবস্থায় আত্মহত্যা করা খুব যুক্তিসঙ্গত ব্যাপার হবে।
আত্মহত্যা! আমি চমকে উঠে ক্রিশির দিকে তাকালাম, কী বলছ তুমি?
আমি ঠিকই বলছি। ক্রিশি শান্ত গলায় বলল,আমি আপনাকে ধারালো একটা ছোরা এনে দিতে পারি। কব্জির কাছে একটা ধমনী কেট দিলে রক্তক্ষরণে অল্প সময়ে মৃত্যুবরণ করতে পারেন। আপনার সমস্ত সমস্যার যে হবে সবচেয়ে সহজ সমাধান।
আমি বিস্ফারিত চোখে ক্রিশির দিকে তাকিয়ে রইলাম, নিজের কানকে আমার বিশ্বাস হয় না যে আমার একমাত্র কথা বলার সঙ্গী একটি নিম্নশ্রেণীর রবোট আমাকে আত্মহত্যা করার পরামর্শ দেবে। আমি খুব সঙ্গত কারণেই ক্রিশির কথাটি উড়িয়ে দিলাম।
কিন্তু সারাদিন ঘুরেফিরে আমার কথাটি মনে হতে লাগল। আমি যতবারই কথাটি ভাবছিলাম প্রত্যেকবারই সেটাকে খুব যুক্তিসঙ্গত একটা সমাধান বলে মনে হতে লাগল। সন্ধেবেলা সত্যি সত্যি আমি আত্মহত্যা করব বলে ঠিক করলাম এবং এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে এই প্রথমবার আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের শান্তি অনুভব করতে থাকি। পৃথিবীর এই ভয়ঙ্কর ধ্বংসস্থূপ, রবোটদের নৃশংস অত্যাচার, ক্ষুধা–তৃষ্ণা, শরীরের যন্ত্রণা–সবকিছু থেকে। আমি মুক্তি পাব! আর আমাকে পশুর মতো বেঁচে থাকতে হবে না। ভয় আতঙ্ক আর হতাশায় ডুবে যেতে হবে না। আমার জীবন কেমন হবে আমি নিজে সেটা ঠিক করব।
আমি নিজের ভিতরে এত বিস্ময়কর একটা শান্তি অনুভব করতে থাকি যে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। অনেকদিন পর আমি প্রথমবার অনেক যত্ন করে নিজেকে পরিষ্কার করে নিই। বেছে বেছে সুস্বাদু একটা খাবার বের করে প্লেটে সাজিয়ে পানীয়ের গ্লাসে লাল রঙের খানিকটা পানীয় ঢেলে সত্যিকারের খাবারের মতো ধীরে ধীরে খেয়ে উঠি।
রাত গভীর হলে আমি আমার ব্যাগটায় মাথা রেখে আকাশের নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে হতে থাকে লক্ষ কোটি যোজন দূরে থেকে নক্ষত্রগুলো বুঝি গভীর ভালবাসা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চারপাশে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীর একটি বিশাল ধ্বংসস্তূপ, কিন্তু এখন কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না।