আমি আপনার সাথে পুরোপুরি একমত নই।
কেন?
আপনার খাবার ও পানীয়ের সমস্যা মিটে গেছে কিন্তু আরো বড় বড় সমস্যা রয়েছে।
কী সমস্যা?
বায়ুমণ্ডল। পৃথিবীর বাতাসে ভয়ঙ্কর তেজস্ক্রিয়তা। মানুষের বসতিতে বাতাস পরিশুদ্ধ করা হয়, এখানে কোনো পরিশোধর নেই। আপনি প্রত্যেকবার নিশ্বাস নিয়ে বুকের ভিতর তেজস্ক্রিয় বস্তু জমা করছেন। আপনার মৃত্যুর কারণ হবে বায়ুমণ্ডলের তেজস্ক্রিয়তা।
আমি এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক নিয়ে ক্রিশির কথা শুনতে থাকি। রবোট না হয়ে মানুষ হলে সম্ভবত এই কথাগুলোই আরো সুন্দর করে বলতে পারত। আমি ব্যাগ থেকে পানীয়ের বোতলটি বের করে এক ঢোক খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ক্রিশি–
বলুন। বাতাসে কতটুকু তেজস্ক্রিয়তা–সেটা দিয়ে আমি কবে নাগাদ মারা যাব? হিসেব করে বের করতে পারবে?
পারব মহামান্য কুশান।
বের কর দেখি।
ক্রিশি তার শরীরের যন্ত্রপাতি বের করে কিছু একটা পরীক্ষা করে খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, মহামান্য কুশান।
বল। কিছু একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটেছে।
কী ঘটেছে?
বাতাসে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। মানুষের বসতিতে পরিশুদ্ধ বাতাস আর এই বাতাসে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।
আমি চমকে উঠলাম, কী বললে তুমি? কী বললে?
বাতাসে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ দশমিক শূন্য শূন্য দুই রেম।
গ্রুস্টান আমাদের মিথ্যে কথা বলে আটকে রেখেছে! সে কখনো চায় নি আমরা বসতি থেকে বের হই।
মহামান্য গ্রুস্টান সম্পর্কে অবমাননাকর কথা বলা অত্যন্ত অবিবেচনার কাজ। তিনি নিশ্চয়ই কিছু একটা জানেন যেটা আমরা জানি না।
ছাই জানে।
মহামান্য গ্রুস্টান সম্পর্কে অবমাননাকর কথা বলা
আমি ধমক দিয়ে ক্রিশিকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, চুপ করবে তুমি?
ক্রিশি চুপ করে গেল।
আমি বুক ভরে কয়েকবার নিশ্বাস নিলাম। পৃথিবী তার নিজস্ব উপায়ে তার প্রকৃতিকে আবার মানুষের বাসের উপযোগী করে তুলছে? আমি চারদিকে তাকাই, কী কদর্য ধ্বংসস্তূপ! একদিন আবার এই ধ্বংসস্তূপে নতুন জীবন গড়ে উঠবে? রাস্তার পাশে ঘাস, দুপাশে বড় বড় গাছ, গাছে পাখি। ঢালু উপত্যকায় ছোট ছোট বাসা, সেখানে মানুষ। বাইরে শিশুরা খেলছে। আবার হবে সবকিছু?
আমি বুকের ভিতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করতে থাকি। ক্রিশি আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। সে কি আমার উত্তেজনা অনুভব করতে পারছে?
আমি নরম গলায় বললাম, ক্রিশি।
বলুন মহামান্য কুশান।
আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কত?
আপনি বিশ্বাস নাও করতে পারেন কিন্তু আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতকরা আটচল্লিশ দশমিক দুই!
চমৎকার! আমি ভেবেছিলাম শতকরা আশি ভাগের উপরে হবে।
না। এখন আপনার প্রাণের ঝুঁকি আসবে সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে।
কোথা থেকে?
রবোট।
আমি অবাক হয়ে বললাম, রবোট?
হ্যাঁ, চারদিকে অসংখ্য নিয়ন্ত্রণহীন রবোট ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখতে পেলে তারা সম্ভবত আপনাকে হত্যা করবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তারা কেন খামাখা আমাকে হত্যা করবে? আমি কী করেছি।
তাদের যুক্তিতর্ক আমার অনুভবের সীমার বাইরে।
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আমাকে এখন কী করতে হবে জান ক্রিশি?
কী?
বহুদূরে মানুষের একটা বসতি খুঁজে বের করতে হবে। সেখানে গিয়ে আবার নূতন করে জীবন শুরু করতে হবে।
সেটি অত্যন্ত অবিবেচনার কাজ হবে মহামান্য কুশান।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
গ্রুস্টান পৃথিবীর প্রত্যেকটা লোকালয়ে আপনার পরিচিতি পাঠিয়ে দিয়েছে। সবাইকে বলে দিয়েছে আপনি মানবসভ্যতাবিরোধী একজন দুষ্কৃতকারী। সবাইকে বলেছে আপনাকে দেখামাত্র যেন হত্যা করা হয়।
তুমি–তুমি আগে আমাকে এ কথা বল নি কেন?
আপনি আমাকে আগে জিজ্ঞেস করেন নি।
আমি হতবাক হয়ে বসে রইলাম। হঠাৎ করে বুকের ভিতরে এক গভীর শূন্যতা অনুভব করতে থাকি। বিশাল এই ধ্বংসস্তূপে, জঞ্জাল, আবর্জনায়, নিয়ন্ত্রণহীন রবোটদের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে একা একা বেঁচে থাকতে হবে? আমি একা একা ঘুরে বেড়াব একটা নিশাচর প্রাণীর মতো? একটা জড়বুদ্ধি রবোট হবে আমার কথা বলার সঙ্গী? আমার একমাত্র আপনজন?।
আমি এক গভীর বিষণ্ণতায় ডুবে গেলাম।
০৪. কারা যেন নিচু গলায় কথা বলছে
গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল, শুনতে পেলাম কারা যেন নিচু গলায় কথা বলছে। আমি লাফিয়ে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। অন্ধকারে চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করছিলাম হঠাৎ করে আমার উপর তীব্র আলো এসেড়ে। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে আমি কোনোমতে উঠে বসি, প্রচণ্ড আলোতে চোখ ধাধিয়ে গেছে, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
খসখসে গলায় কে যেন বলল, দশম প্রজাতির রবোট। চমৎকার হাতের কাজ।
খনখনে এক ধরনের যান্ত্রিক গলায় এরকজন বলল, এর মাঝে কিউ কপোট্রন রয়েছে। কখনো দেখি নি শুধু এর গল্প শুনেছি। ভিতরে নিউরাল নেটওয়ার্ক।
ক্রায়োজেনিক কাজ একেবারে প্রথম শ্রেণীর।
মোটা গলায় একজন বলল, এটা কেমন করে এখানে এল?
খসখসে কণ্ঠস্বরটি আবার বলল, স্ক্যান করে দেখ তাপমাত্রার কোনো তারতম্য নেই।
কয়েকজন একসাথে বলল, ঠিকই বলেছ।
আমি এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ শুনতে থাকি।
পাওয়ার সাপ্লাইটা কোথায়? কানের নিচে?
উঁহু। বুকের কাছে। সৌরসেল থাকার কথা।