ক্রিশি তার যান্ত্রিক মুখে একাগ্রতার একটা ছাপ ফোঁটানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, আমি অবশ্যি চেষ্টা করব।
ক্রিশি।
বলুন।
আমি নরম গলায় বললাম, তুমি এসেছ তাই আমার খুব ভালো লাগছে।
শুনে খুব খুশি হলাম।
ক্রিশি।
বলুন।
তুমি খুশি হলে তার অর্থ কী? রবোট কেমন করে খুশি হয়?
ক্রিশি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, রবোট খুশি হওয়ার অর্থ কপোট্রনের তৃতীয় প্রস্থচ্ছেদে বড় মডিউলের সাতাশি নম্বর পিনের ভোল্টেজের পার্থক্য চুয়াল্লিশ মিলি ভোল্টের কম।
ও আচ্ছা।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে চতুষ্কোণ এক টুকরা খাবার বের করে খেতে শুরু করি। ক্রিশির সাথে দেখা হওয়ার উত্তেজনায় এতক্ষণ টের পাই নি, হঠাৎ করে বুঝতে পেরেছি ভীষণ খিদে পেয়েছে। খেতে খেতে আমি ক্রিশির দিকে তাকাই, নির্বোধ চতুর্থ শ্রেণীর একটা রবোট অথচ তার জন্যে আমি বুকের ভিতর এক ধরনের মমতা অনুভব। করছি। কিছুক্ষণ আগেও বুকের ভিতরে যে ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গতা এবং গম্ভীর হতাশা ছিল হঠাৎ করে সেটা কেটে গেছে, আমি হঠাৎ করে এক ধরনের শক্তি অনুভব করছি! তুচ্ছ চতুর্থ শ্রেণীর একটি রবোটের জন্যে?
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ক্রিশি আমার মাথার কাছে চুপচাপ বসে আছে। আমাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে বলল, শুভ সকাল মহামান্য কুশান।
শুভ সকাল।
আপনি কি ভালো করে ঘুম থেকে উঠেছেন?
হ্যাঁ, আমি ভালো করে ঘুম থেকে উঠেছি।
আপনি যখন ঘুমিয়েছিলেন আমি তখন খাবারের ফ্যাক্টরি থেকে ঘুরে এসেছি।
চমৎকার!
ফ্যাক্টরিতে কিছু জিনিস পেয়েছি যেটাকে জৈবিক মনে হয়েছে।
সত্যি?
হ্যাঁ, আপনার জন্যে একটু নমুনা এনেছি।
আমি উঠে বসে বললাম, দেখি কী নমুনা।
ক্রিশি তার বুকের মাঝে একটা ছোট বাক্স খুলে তার মাঝে থেকে কয়েকটা ছোট ছোট চৌকোনো খাবার বের করে দিল। আমি হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম কিছু শুকনো প্রোটিন। ক্রিশির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললাম, ক্রিশি, তুমি দারুণ কাজ করে ফেলেছ। সত্যি সত্যি কিছু প্রোটিন বের করে ফেলেছ! কতটুকু আছে সেখানে?
বার হাজার তিন শ নয় কিউবিক মিটার। এক অংশ থেকে এক ধরনের বায়বীয় গ্যাস বের হচ্ছে। তার রং সবুজাভ হলুদ।
তার মানে পচে গেছে।
সেই অংশে ছয় পা–বিশিষ্ট তিন মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের এক ধরনের প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে।
শুধু পচে যায় নি, পোকা হয়ে গেছে।
প্রাণীটিকে দেখে উচ্চ শ্রেণীর প্রোটিন বলে মনে হল।
তুমি ঠিকই বলেছ, কিন্তু আশা করছি আমার সেটা খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে না। চল ফ্যাক্টরিটা গিয়ে দেখে আসি।
চলুন
আমি আমার ব্যাগটা হাতে নিয়ে ক্রিশির পিছু পিছু হাঁটতে থাকি।
.
বিধ্বস্ত খাবারের ফ্যাক্টরিতে সত্যি সত্যি বাক্স বোঝাই খাবার পাওয়া গেল। বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু তার মাঝেও খুঁজে ক্রিশি অনেকগুলো বাক্স নামিয়ে আনল। যার মাঝে এখনো প্রচুর শুকনো খাবার রয়ে গেছে। আমি বেছে বেছে কিছু খাবার তুলে নিলাম, শেষ হয়ে গেলে আবার এখানে ফিরে আসা যাবে। এখন যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে পানীয়, আমার কাছে যেটুকু আছেটা দিয়ে সপ্তাহ খানেকের বেশি চলবে বলে মনে হয় না।
সারাদিন হেঁটে ঠিক দুপুরবেলা বিশ্রাম নিতে বসেছি। সূর্য ঠিক মাথার উপরে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ধংসস্তূপ ধিকিধিকি করে জ্বলছে। আমি বড় একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে তার ছায়ায় বসে আছি। ক্রিশি আমার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তার ভিতর থেকে ছোট গুঞ্জনের মতো শব্দ হতে থাকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিসের শব্দ ওটা ক্রিশি?
গরম খুব বেশি। কপোট্রন শীতল রাখার জন্যে ক্রায়োজেনিক কুলার চালু হয়েছে।
তোমার ভিতরে ক্রায়োজেনিক কুলার আছে আমি জানতাম না।
ক্রিশি কোনো কথা না বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি দেখলাম গরমে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে।
ব্যাপারটি প্রথমে আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হল না কিন্তু হঠাৎ করে আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, চিৎকার করে বললাম, ক্রিশি!
কী হয়েছে মহামান্য কুশান?
তোমার কপালে ঘাম।
ঘাম?
কাছে আস, আমি তার কপাল স্পর্শ করি, তার মাথা হিমশীতল।
আমি আনন্দে চিৎকার করে বললাম, ইয়া হু!
আপনি অর্থহীন শব্দ করছেন মহামান্য কুশান।
হ্যাঁ। তুমি জান আমাদের পানীয়ের সমস্যা মিটে গেছে।
মিটে গেছে?
হা। বাতাসে সব সময় জলীয় বাষ্প থাকে। কোনোভাবে সেটাকে ঠাণ্ডা করলেই পানি বের হয়ে আসবে। তুমি যখন ক্রায়োজেনিক কুলার দিয়ে তোমার কপোট্রন শীতল করেছ তোমার মাথা ঠাণ্ডা হয়ে সেখানে জলীয় বাষ্প বিন্দু বিন্দু পানি হয়ে জমা হয়েছে। আমাদের যখন পানির দরকার হবে তুমি কিছু একটা ঠাণ্ডা করতে শুরু করবে–সাথে সাথে সেখানে পানি জমা হবে।
ক্রিশি মাথা নেড়ে বলল, পদ্ধতিটি প্রাচীন, এটি শক্তির বিশাল অপচয় এবং সময়সাপেক্ষ। এই পদ্ধতিতে খাবার পানি বের করা বর্তমান প্রযুক্তির অপব্যবহার
তুমি চুপ কর ক্রিশি! আমাকে এখন প্রযুক্তির অপব্যবহারের ওপর বক্তৃতা দিও না। আগে বেঁচে থাকা তারপর অন্য কিছু। আমার আগেই এটা চিন্তা করা উচিত ছিল। আসলে সমস্যাটা কোথায় জান?
কোথায়?
গ্রুস্টান আমাদের সাধারণ বিজ্ঞানও শেখাতে চায় না। আমরা বলতে গেলে কিছুই জানি না। নিজে থেকে বেঁচে থাকার কিছুই আমরা জানি না। গত দুই দিন একা একা থেকে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বিশেষ কঠিন নয়। তুমি কী বল ক্রিশি