গাড়িটা আমাদের শহরের গেটের দিকে আসছিল। তাই আমি আর টিশাও গেটের কাছাকাছি চলে এলাম। গাড়িটা কাছাকাছি চলে এসেছে এবারে ভেতরেও দেখা যাচ্ছে। স্টিয়ারিং হাতে একজন মাত্র মানুষ–আর কেউ কোথাও নেই। একজন মানুষ একটা অদ্ভুত খেলনা গাড়িতে করে আমাদের শহরের দিকে আসছে। কেন আসছে?
ঠিক তখন আমরা প্রথম গুলির শব্দ শুনলাম, আমাদের শহরের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেন্ট্রি গুলি করেছে। বিদঘুঁটে খেলনার মতো গাড়িটা তখন একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। আমি আর টিশা কংক্রিটের আড়াল থেকে দেখতে পেলাম গাড়ির ভেতর থেকে মানুষটা খুব ধীরেসুস্থে বের হয়ে এল, এবার আমরা তার চেহারা দেখতে পেলাম, মাথায় একটা হ্যাঁট, মুখে দাড়ি আর গোঁফ। তার কাঁধে বিচিত্র একটা পাখি বসে আছে। মানুষটা গাড়ির ভেতর থেকে একটা ছোট লাঠি বের করল, লাঠির মাথায় এক টুকরো সাদা কাপড় বেঁধে একটা পতাকার মতো তৈরি করল, তারপর সেটা নাড়াতে নাড়াতে হেঁটে হেঁটে গেটের দিকে আসতে থাকে। মানুষটার ভেতরে কোনো ভয়-ডর নেই, কোনো দুশ্চিন্তা নেই।
আমি অবাক হয়ে বললাম, “সাদা পতাকা দিয়ে কী করছে মানুষটা?”
টিশা বলল, “সাদা পতাকা হচ্ছে শান্তির পতাকা। মানুষটা বোঝাতে চাইছে সে মারামারি করতে আসেনি।”
“তুমি কেমন করে জান?”
“আমি বইয়ে পড়েছি।”
“মানুষটার কাঁধে ওটা কী পাখি?”
টিশা বলল, “বাজপাখি”
“কেন?”
“শখ। আগে মানুষ বাজপাখি পুষত।”
আমি আর টিশা কংক্রিটের পেছনে ঘাপটি মেরে বসে কী হয় দেখতে থাকি। মানুষটা পতাকা দুলিয়ে দুলিয়ে কাছে আসতে থাকে। তখন গেট থেকে সেন্ট্রি চিৎকার করে বলল, “দাঁড়াও।”
মানুষটা দাঁড়িয়ে গেল। সেন্ট্রি বলল, “আর কাছে আসবে না। খবরদার।”
মানুষটা মাথা নেড়ে রাজি হয়ে সেখানে পা ছড়িয়ে বসে গেল। আমরা দেখলাম মানুষটার বিদঘুঁটে গাড়ির ভেতর থেকে দুটো কুকুর লাফ দিয়ে নেমে এদিক-সেদিক গন্ধ শুকতে শুকতে তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মানুষটার কাছে এসে কুকুর দুটো তার শরীর ঘেঁষে বসে পড়ল। মানুষটা তখন কুকুরগুলোর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকে।
সেন্ট্রিগুলো যখন দেখল মানুষটা একা, তার সাথে কোনো অস্ত্র নেই, সঙ্গী হচ্ছে একটা পাখি আর দুটো কুকুর তখন তারা অনুমান করল একে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তখন তারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নিয়ে লোকটার কাছে গেল, তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল, আমরা দূর থেকে তাদের কথাগুলো ঠিক শুনতে পেলাম না। একটু পরে দেখলাম মানুষটা উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের শহরের গেটের দিকে হেঁটে হেঁটে আসছে, তার পিছু পিছু দুটি কুকুর অলস ভঙ্গিতে হাঁটছে। আমাদের শহরের সেন্ট্রিরা তাদের ভয়ংকর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র মানুষটার দিকে তাক করে ধরে রেখেছে।
টিশা বলল, “চলো যাই।”
“কোথায়?”
“নিচে। দেখি মানুষটা কী করে।”
আমি বললাম, “তুমি ভেবেছ মানুষটা কী করে সেটা তোমাকে দেখতে দেবে? নিশ্চয়ই কমান্ড্যান্টের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।”
“নিলে নেবে। আমাদের কাছে যেতে না দিলে চলে আসব। সমস্যা কোথায়?” কথা শেষ করে আমি কী বলি সেটার জন্য অপেক্ষা না করে টিশা কংক্রিটের টুকরোর উপর লাফ দিতে দিতে নিচে নামতে থাকে। আমি আর কী করব? তার পিছু পিছু নামতে শুরু করলাম।
গেটের কাছাকাছি গিয়ে দেখি সেখানে মানুষের ছোটখাটো একটা জটলা। মনে হচ্ছে এই মানুষটার খবর পেয়ে অনেকেই মজা দেখতে চলে এসেছে। আমি আর টিশাও মানুষের ভিড়ের মাঝে মিশে গিয়ে কী হচ্ছে দেখার চেষ্টা করলাম।
দূর থেকে মানুষটাকে যত বিচিত্র মনে হয়েছিল, কাছে থেকে তাকে আরো বিচিত্র মনে হলো। মাথার হ্যাঁটটা খুলে পেছনে ঝুলিয়ে নিয়েছে। মাথায় লম্বা চুল ঝুঁটির মতো বেঁধে রেখেছে। মুখ বোঝাই কাঁচাপাকা দাড়ি আর গোঁফ। রোদে পোড়া চেহারা, শুধু চোখ দুটো কেমন জানি ঝকঝক করছে। খাকি একটা শার্ট, ভুসভুসে খাকি প্যান্ট। পায়ের জুতো খুবই অদ্ভুত, আমরা কখনো এরকম জুতো দেখিনি। মনে হয় গাড়ির টায়ার কেটে নিজেই তৈরি করে নিয়েছে।
একজন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?”
মানুষটা বলল, “আমি যাযাবর।”
যাযাবর শব্দটার অর্থ বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পারল না। আমিও বুঝতে পারলাম না, টিশার দিকে তাকালাম, টিশা ফিসফিস করে বলল, “যারা ঘুরে বেড়ায় তারা যাযাবর।”
“ঘুরে বেড়ায়?”
“হ্যাঁ”
“ঘুরে কী করে?”
“কিছু করে না।”
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে কেন এসেছ?”
তখন সেন্ট্রি তার অস্ত্র ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “কোনো কথা না। কমান্ড্যান্ট আসার আগে কোনো কথা না।”
আমাদেরকে তাড়িয়ে না দিয়ে শুধু কথা বলতে নিষেধ করেছে, তাতেই আমরা খুশি।
কিছুক্ষণের মাঝেই কমান্ড্যান্ট আর তার সাথে দুজন সহকারী চলে এল। একজন রুপালি চুলের মহিলা অন্যজন কঠিন চেহারার
একজন পুরুষ। কমান্ড্যান্ট আমাদের এভাবে জটলা করে থাকতে দেখে একটু বিরক্ত হলো কিন্তু চলে যেতে বলল না। সোজাসুজি বিচিত্র মানুষটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। ঠিক কী কারণ জানা নেই তখন কুকুর দুটো উঠে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় চাপা গর্জন করল। ঘাড়ে বসে থাকা বাজপাখিটাও প্রথমবার মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে দেখে ডানা ঝাঁপটে তীক্ষ্ণ এক ধরনের শব্দ করল।