টিশা কারো সাথে খুব বেশি কথা বলে না, কমিউনের সেই সভায় কমান্ড্যান্টের সাথে তার সেই কথোপকথনের পর অন্যেরাও তার সাথে কথা বলার সাহস পায় না। কে জানে কখন কে কী বিপদে পড়বে, কাকে আবার ডিটিউন করে দেবে!
দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে খেতে খেতে আমি দেখতে পেলাম টিশা ধসে পড়া একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে তার ভিডি রিডারে বই পড়ছে। পাশে তার ভোলা খাবারের প্যাকেট, সেখান থেকে একটা রুটির টুকরো বের করে আধখানা খেয়ে মনে হয় খেতেই ভুলে গেছে।
আমি দেয়াল থেকে লাফ দিয়ে নেমে টিশার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার পায়ের শব্দ শুনে টিশা মুখ তুলে তাকাল। যদিও সে বুঝতে দিতে চায় না তারপরেও আমি বুঝতে পারলাম আমাকে দেখে তার চোখে-মুখে একটা আনন্দের ছায়া পড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী পড় টিশা?”
“সময় পরিভ্রমণের উপর একটা বই।”
“সময় পরিভ্রমণ? সেটা আবার কী?”
“এই মনে করো ভবিষ্যতে না হলে অতীতে চলে যাওয়া।”
আমি হেসে বললাম, “যাও! সেটা কি আবার সম্ভব নাকি?”
টিশা মুখ গম্ভীর করে বলল, “বিজ্ঞানীরা মনে করেন সম্ভব।”
আমি টিশার পাশে বসে বললাম, “ঠিক আছে সম্ভব হলে সম্ভব। তাতে তোমার আমার কী? তুমি কি ভবিষ্যতে যেতে পারবে? অতীতে যেতে পারবে?”
“যেতে না পারলে নাই, কিন্তু জানতে তো ক্ষতি নেই।”
“তার জন্য এত তাড়াহুড়ার কী আছে? ক্রেনিয়াল লাগালে একদিনে সব জেনে যাবে। এত কষ্ট করে ভিডি রিডারে বই পড়তে হবে কেন?”
টিশা হাসল, বলল, “বই পড়তে আমার কষ্ট হয় না। আমি দিনরাত বই পড়তে পারব।”
আমি বললাম, “তুমি পাগল।”
টিশা হাসল, বলল, “মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ। মনে হয় আমি আসলেই পাগল।”
টিশা নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দূরে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় যদি আমাদের পড়তে না শেখাত তাহলে কী হতো?”
আমি তার কথা বুঝতে পারলাম না। বললাম, “কেন? পড়তে শেখাবে না কেন?”
“হতেও তো পারত! সবাই মিলে ঠিক করত কাউকে পড়াতে শেখানোর দরকার নেই। যখন যোলো বছর বয়স হবে তখন মাথার মাঝে ক্রেনিয়াল বসিয়ে সেখান দিয়ে পড়তে শেখাবে!”
আমি বিষয়টা এভাবে চিন্তা করিনি। টিশা ঠিকই বলেছে আমাদেরকে ছোট থাকতে পড়তে শিখিয়েছে। না শেখালেও ক্ষতি ছিল না। পড়তে শিখে আমাদের অবশ্যি খুব বেশি লাভ হয়নি, ক্ষতিও হয়নি। টিশার অনেক লাভ হয়েছে, সে দিনরাত বই পড়তে পারে। কে জানে এটা হয়তো লাভ না, এটা হয়তো ক্ষতি। পড়তে পড়তে টিশা অন্যরকম হয়ে গেছে, এখন সে অন্যভাবে চিন্তা করে। সে জন্য টিশা কোনদিন কোন বিপদে পড়বে কে জানে!
আমি টিশার পাশে বসে রইলাম, টিশাও চুপচাপ বসে রইল। আমি বললাম, “তুমি খাচ্ছ না কেন? খাও।”
টিশা বলল, “হ্যাঁ খাব।” কিন্তু টিশা খেল না, বসেই রইল।
বিকেল বেলা যখন আমাদের কাজ শেষ হলো তখন আমরা সবাই দল বেঁধে পুরোনো জেনারেটরের বিল্ডিং থেকে বের হয়ে এলাম। সবাই গল্প করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু টিশা একা একা হাঁটছে। আমি টিশার কাছে গিয়ে বললাম, “টিশা! বিকেল বেলা তুমি কী করবে?”
“কী করব? কিছু না।”
“চলো তাহলে প্রাচীরে যাই।” আমি জানি কংক্রিটের স্থূপ দিয়ে ঘেরাও করে তৈরি করা প্রাচীরে উঠে দূরে তাকিয়ে থাকতে টিশা খুব পছন্দ করে।
টিশার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “চলো, যাই।”
আমরা দুজন তখন ভাঙা ধসে যাওয়া দালান, ইট পাথর কংক্রিটের জঞ্জাল, জং ধরা ভাঙা যন্ত্রপাতি পার হয়ে প্রাচীরের নিচে এসে দাঁড়ালাম। এখানে কংক্রীটের মাঝে ছোট একটা ফাঁক আছে। অনেকদিন আগে আমি আর টিশা এই ফাঁক আবিস্কার করেছি। আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ এই ফাঁকটুকুর কথা জানে না। ইচ্ছে করলে এই ফাঁকটুকু দিয়ে শহর থেকে বের হওয়া সম্ভব-কিন্তু বের হওয়ার কোনো প্রয়োজন হয়নি বলে কখনো বের হওয়ার চেষ্টা করিনি। আমরা একবার ভেতরে উঁকি দিলাম তারপর টিশা কংক্রিটের ভাঙা টুকরোগুলোয় পা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে প্রাচীরের উপরে উঠে যেতে থাকে। আমি তার মতো এত সহজে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে পারি না, তাই টিশার পিছু পিছু সাবধানে প্রাচীরের উপর উঠে দাঁড়ালাম। শহরের ভেতর একটা বন্ধ বন্ধ ভাব আছে, উঁচু উঁচু দালানগুলো মনে হয় সবকিছু আটকে রেখেছে। এই প্রাচীরের উপর উঠলে দেখা যায় চারদিক খোলা, যতদূর চোখ যায় শুধু লালচে বালি। মনে হয় আকাশটা একটা বাটির মতো পুরো পৃথিবীটা ঢেকে রেখেছে।
আমি আর টিশা যখন প্রাচীরের উপর হাঁটছি তখন হঠাৎ করে টিশা বলল, “রিহি! দেখো, দেখো।”
আমি মাথা ঘুরে তাকালাম, বহুদূর থেকে ধুলো উড়িয়ে একটা গাড়ি ছুটে আসছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, এর আগে কখনো আমরা কেউ একটা গাড়িকে ছুটে যেতে দেখিনি। বাইরে দস্যুদল, বুনো পশু, কত রকম বিপদ, সেখানে কেউ একা যায় না। যখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয় সবাই দল বেঁধে যায়। একসাথে তখন অনেক গাড়ি থাকে। সেই গাড়ির সামনে-পিছে অস্ত্র হাতে প্রহরী থাকে। এখানে কিছু নেই, শুধু একটা গাড়ি। কী আশ্চর্য!
গাড়িটা ধুলা উড়িয়ে ঠিক আমাদের শহরের দিকেই আসছে, দেখতে দেখতে গাড়িটা স্পষ্ট হলো। এটা আমাদের দেখা কোনো গাড়ির মতো না, এটা অন্য রকম গাড়ি। দেখে মনে হয় জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা গাড়ি, ভুল করে তৈরি করা গাড়ি। মনে হয় একটা বড় সাইজের খেলনা গাড়ি। গাড়ির ভেতরে কারা বসে আছে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না, মনে হয় দস্যুদল। আমরা শুধু দস্যুদলের নাম শুনেছি তাদের সম্পর্কে ভয়ানক ভয়ানক গল্প শুনেছি কিন্তু কখনো তাদেরকে দেখিনি। তাই ভালো করে দেখার জন্য আমরা প্রাচীরের উপর দিয়ে ছুটে যেতে থাকি। দস্যুদল দূর থেকে আমাদেরকে গুলি করে দেবে কি না সেটা নিয়ে একটু ভয় করছিল, তাই চেষ্টা করছিলাম কংক্রিটের আড়ালে আড়ালে থাকতে।