টিশা ভয় পাওয়া গলায় বলল, “আমার কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমি শুধু জানতে চাচ্ছিলাম”
“তুমি কেন এমন একটা বিষয় জানতে চাইবে?”
টিশা তার গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল, কিন্তু স্বাভাবিক রাখতে পারল না, প্রায় ভাঙা গলায় বলল, “আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, আমি শুধু জানতে চাইছিলাম যে আমাদের কিছু দিতে হবে কি না। সব সময় দেখে এসেছি কিছু একটা পেতে হলে কিছু একটা দিতে হয়।”
কমান্ড্যান্টের মুখটা দেখতে দেখতে হঠাৎ করে কেমন জানি কঠিন হয়ে ওঠে। তাকে দেখতে একটা নিষ্ঠুর মানুষের মতো মনে হতে থাকে। কমান্ড্যান্ট প্রায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “কিছু একটা পেতে হলে কিছু একটা দিতে হয়-কী আশ্চর্য!”
কমান্ড্যান্ট আরো কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল ঠিক তখন দরজায় দাঁড়ানো গার্ডদের ধাক্কা দিয়ে উদভ্রান্তের মতো দেখতে একজন মহিলা হলঘরে ঢুকে গেল, প্রায় ছুটে কমান্ড্যান্টের কাছে যেতে যেতে চিৎকার করে বলতে থাকে, “আমার হুনা কই? হুনা! আমার হুনা।”
আমরা সবাই হুনার মাকে চিনতে পারলাম, খুব হাসিখুশি একজন মহিলা কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে দেখাচ্ছে প্রায় উন্মাদিনীর মতো। হুনার মা বেশি দূর যেতে পারল না তার আগেই পাহাড়ের মতো বড় দুজন গার্ড এসে দুই পাশ থেকে তাকে ধরে প্রায় টেনে হলঘরের বাইরে নিতে থাকে।
কমান্ড্যান্ট সেদিকে তাকাল না, তাকে দেখে মনে হলো সে পুরো ব্যাপারটি একটুও দেখেনি।
আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের সভা আজকের মতো এখানেই শেষ।”
টিশা ফিসফিস করে বলল, “বুঝেছ রিহি?”
আমি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “কী বুঝব?”
“হুনা আর লুক কোথায়?”
“কোথায়?”
“বিজ্ঞানী লিংলিকে দিয়েছে। আরো দেবে। তোমাকে আমাকেও দেবে। যারা একটু বেশি বোঝে সবাইকে দেবে।”
“কেন?”
“কিছু একটা পেতে হলে কিছু একটা দিতে হয়!” বলে টিশা আবার হাসির ভঙ্গি করল, আনন্দহীন এক ধরনের হাসি।
০৩. একটা বিশাল জেনারেটরের বড় বড় নাট
একটা বিশাল জেনারেটরের বড় বড় নাট এবং বল্টগুলো আমরা সবাই মিলে খুলছিলাম। কেন খুলছি আমরা জানি না। আমাদেরকে খুলতে বলেছে তাই খুলছি। আবার যখন লাগাতে বলবে তখন লাগাব। জেনারেটরের ভেতরে কী হয়, কেমন করে কাজ করে সেগুলো জানে মাহা। মাহা আমাদের থেকে মাত্র দুই বছরের বড়, মাথার মাঝে ক্রেনিয়াল লাগানোর পর সে কয়েকদিনের মাঝে জেনারেটর ঠিক করা শিখে গেছে। সে একটা নষ্ট জেনারেটরের সামনে দাঁড়িয়ে তার মিটারগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারপর এখানে সেখানে ঠোকা দেয়। কিছু একটা শোনে তারপর আমাদের হাতে বড় বড় রেঞ্জ দিয়ে নাটবল্টগুলো দেখিয়ে সে আমাদেরকে বলে, “এগুলো খোলো।” আমরা সেগুলো খুলি, তখন সে জেনারেটরের ভেতর ঢুকে যায়। নানারকম তার ধরে টানাটানি করে, তারপর আমাদের বড় বড় মোটা মোটা তার ধরিয়ে দিয়ে একটা ওয়েল্ডিং মেশিন দিয়ে বলে, “ওয়েল্ড করো।” আমরা বড় বড় আর্ক জ্বালিয়ে ওয়েল্ড করি। তারপর মাহা আবার জেনারেটরের ভেতরে ঢুকে কুটুর কুটুর করে কাজ করে, তারপর কালিঝুলি মেখে বের হয়ে আমাদের নাটবল্টগুলো দিয়ে বলে “এগুলো লাগাও।” আমরা সেগুলো লাগাই। লাগানো শেষ হলে মাহা ঘুরে ঘুরে দেখে, তারপর আমাদেরকে বলে, “দূরে সরে যাও।” আমরা দূরে সরে যাই। তখন মাহা বড় বড় সুইচ গায়ের জোরে টেনে ধরে, তখন কড়াত কড়াত শব্দ করে স্পার্ক হয়, কালো ধোঁয়া বের হয় তারপর হঠাৎ করে ঘর ঘর শব্দ করে বিশাল জেনারেটর চালু হয়ে যায়। জেনারেটর ঘরের বড় বড় আলোগুলো জ্বলে ওঠে। আমরা সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠি, শুধু মাহা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে হাসে না, কথা বলে না, গম্ভীর মুখে জেনারেটরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আমাদের দিকে না তাকিয়ে সে হেঁটে হেঁটে চলে যায়। আমরা পেছন থেকে দেখি তার মাথায় একটা গর্ত, সেই গর্তে একটা ধাতব সিলিন্ডার। এটা হচ্ছে ক্রেনিয়াল, এই ক্রেনিয়াল দিয়ে তার মাথার মাঝে জেনারেটরের সব কিছু ঢোকানো হয়েছে। আমাদের বন্ধু মাহা এখন বড় ইঞ্জিনিয়ার। সে এখন আমাদের সাথে বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পায় না। আগে সে সারাক্ষণ গুনগুন করে গান গাইত, এখন গান তো অনেক দূরের কথা সে কখনো কথাই বলে না। আমি বুঝতে পারি না একজন ক্রেনিয়াল লাগিয়ে অনেক কিছু শিখে গেলে কেন সে আর তার পুরোনো বন্ধুদের সাথে কথা বলতে পারে না?
জেনারেটরের বড় বড় নাটবল্টগুলো খুলতে খুলতে দুপুর হয়ে গেল। আমরা তখন কাজ বন্ধ করে বাইরে এসে দেয়ালের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আমাদের খাবারের প্যাকেট বের করে খেতে থাকি। শুকনো রুটি, শুকনো কৃত্রিম প্রোটিনের টুকরা আর বোতলে করে ঝাঝালো পানীয়। বিস্বাদ খাবার, কটু পানীয় কিন্তু সেগুলোই আমরা শখ করে খাই। খাবারগুলো অনেক হিসাব করে তৈরি করা হয়, এগুলো খেলে শরীরের যা যা দরকার সব পেয়ে যায়। অসুখ হয় না, মাংসপেশি গড়ে ওঠে, হাড় শক্ত হয়। তাই আমরা সেই বিস্বাদ খাবার হইচই করে খাই, খেতে খেতে গল্প করি।
শুধু টিশা আমদের গল্পে যোগ দেয় না। সে তার ছোট ভিডি রিডার হাতে নিয়ে একটার পর একটা বই পড়ে যায়। সে কী বই পড়ে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভেবেছিলাম প্রাচীন রোমান্টিক কাব্য আসলে তা নয়, সে কঠিন কঠিন বই পড়ে। মানুষের মস্তিষ্কে কী থাকে, বীজ থেকে গাছ কেমন করে জন্মায়, অণুপরমাণুর গঠন কী রকম, আকাশ থেকে বিদ্যুৎ কেমন করে হয় এই সব নিয়ে বই। তাকে দেখে মনে হয় সে বুঝি মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানোর আগেই সবকিছু শিখে ফেলতে চায়।