মিকি শেষ পর্যন্ত যখন কথা শেষ করল তখন আমরা সবাই প্রথমে চুপচাপ বসে রইলাম। আমাদের বেশির ভাগ মানুষ ততক্ষণে ঠিক কোন প্রশ্নের উত্তরে মিকি এত বড় একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে সেটাই ভুলে গেছি। কমান্ড্যান্ট তখন হাসি হাসি মুখে সবার দিকে তাকাল এবং তখন আমরা বুঝতে পারলাম আবার আমাদের হাততালি দিতে হবে। আমরা তখন আবার জোরে জোরে হাততালি দিলাম।
হাততালি শেষ হবার পর কমান্ড্যান্ট আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আর কোনো প্রশ্ন?” তার কথার ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারলাম কমান্ড্যান্ট চাইছে আরো কেউ একটা প্রশ্ন করুক। কিন্তু প্রশ্ন করার কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত পেছন থেকে একজন ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, “একটা ঘরে গেলে ঘরের আলো কেমন করে জ্বলে ওঠে?”
মিকি বলল, “আমার মস্তিষ্কের তথ্য শুধু জীববিজ্ঞানের তথ্য। অন্য কাউকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।” উত্তরের জন্যে মিকি কুশ আর ক্রিটনের দিকে তাকাল।
ক্রিটন মাথা নেড়ে বলল, “আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু তৈরি হয়েছে কিছু মৌলিক কণা দিয়ে। এই মৌলিক কণাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগের নাম লেপটন, আমাদের সবচেয়ে পরিচিত লেপটন হচ্ছে ইলেকট্রন…”
ক্রিটন ঠিক মিকির কথামতোই কঠিন কঠিন বৈজ্ঞানিক শব্দ ব্যবহার করে খুব জটিল কথা বলতে শুরু করল। মিকির কথা তবু আমরা একটু বুঝেছিলাম, ক্রিটনের কথা আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমরা সবাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকলাম, যখন ক্রিটন শেষ পর্যন্ত থামল আমরা নিজেরাই জোরে জোরে হাততালি দিতে শুরু করলাম।
আমরা ভেবেছিলাম কমান্ড্যান্ট আবার আমাদেরকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বলবে কিন্তু মনে হয় সে টের পেয়েছে আমরা মিকি আর ক্রিটনের কোনো কথাই বুঝতে পারিনি, তাই সে আর চেষ্টা করল না। খানিকক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “এখন তোমরা বুঝতে পেরেছ কীভাবে আমরা আবার একেবারে শূন্য থেকে একটা সভ্যতা তৈরি করতে শুরু করেছি?”
সত্যি কথা বলতে কি আমি ঠিক বুঝতে পারিনি কীভাবে কয়েকজন ছেলেমেয়ের মাথায় ক্রেনিয়াল লাগিয়ে তাদেরকে কঠিন কঠিন জ্ঞানের বিষয় শিখিয়ে দিলেই একটা সভ্যতা তৈরি হয়ে যায়। সভ্যতা জিনিসটা কী আমি সেটাও জানি না!
আমার মতো আরো অনেকেরই মনে হয় এরকম প্রশ্ন ছিল, একজন সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেলল, “সভ্যতা তৈরি করতে কী কী লাগে?”
কমান্ড্যান্ট হাল ছেড়ে দেবার মতো করে মাথা নাড়ল, বলল, “তোমাকে এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। আগের সভ্যতার মূল উপাদানটি ছিল কম্পিউটার নামের একটি যন্ত্র –”
“আমাদের কি কম্পিউটার আছে?”
কমান্ড্যান্ট কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তোমরা শুনে খুব খুশি হবে পৃথিবীর মানুষ আবার নতুন করে কম্পিউটার তৈরি করতে শুরু করেছে। তবে এখন এটাকে কম্পিউটার বলে না। এখন এটার নাম ক্রেনিপিউটার।”
এই প্রথমবার আমরা সবাই সত্যিকারভাবে চমকে উঠে কমান্ড্যান্টের কথা শুনতে আগ্রহী হলাম। প্রায় সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করতে শুরু করল, “কোথায়? দেখতে কেমন? কত বড়? কী করতে পারে?”
কমান্ড্যান্ট হাত নেড়ে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “অনেকদিন থেকে ক্রেনিপিউটার তৈরি করার জন্য কাজ চলছিল। পৃথিবীর সব ফ্যাক্টরি ধ্বংস হয়ে গেছে বলে কাজটি খুব কঠিন। নানা জায়গা থেকে টুকরো টুকরো যন্ত্রপাতি জোগাড় করে তৈরি করতে হচ্ছে। এখান থেকে প্রায় দুশ কিলোমিটার দূরে মানুষের আরেকটা আস্তানা আছে–জ্ঞানবিজ্ঞানে তারা আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। সেখানে একজন বিজ্ঞানী আছে তার নাম হচ্ছে লিংলি। বিজ্ঞানী লিংলি। আসলে বলা উচিত মহাবিজ্ঞানী লিংলি। সেই মহাবিজ্ঞানী লিংলি ক্রেনিপিউটার তৈরি করছে।”
কমান্ড্যান্ট একটু থামল, আমরা ঠিক বুঝতে পারলাম না, এখন মহাবিজ্ঞানী লিংলির জন্য আমাদের চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করার দরকার আছে কি না। কয়েকজন অবশ্যি আনন্দধ্বনি করেও ফেলল।
কমান্ড্যান্ট মনে হলো এবারে আনন্দধ্বনির জন্য অপেক্ষা করছে না, সে আবার কথা বলতে শুরু করল, বলল, “তোমরা শুনে খুব খুশি হবে। আমাদের এই শহর থেকে আমরা বিজ্ঞানী লিংলির সাথে যোগাযোগ করেছি এবং বিজ্ঞানী লিংলি আমাদের সব রকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।”
এবারে আমরা হাততালি দিয়ে আনন্দের শব্দ করলাম। কমান্ড্যান্ট বলতে থাকল, “বিজ্ঞানী লিংলি বলেছে এই দুই শহরের
মাঝে একশ বছর আগের যে নেটওয়ার্কের যোগাযোগ আছে সেটাকে আবার কার্যকর করে নতুন সভ্যতার নতুন ক্রেনিপিউটারের সাথে যোগাযযাগ করে দেবে।”
আমরা আবার আনন্দের শব্দ করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু তার আগেই হঠাৎ টিশা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “তার জন্য আমাদের বিজ্ঞানী লিংলিকে কী দিতে হবে?”
ঠিক কী কারণ জানা নেই হঠাৎ করে পুরো হলঘরটি একেবারে কবরের মতো নীরব হয়ে গেল, মুহূর্তে পুরো পরিবেশটাও কেমন জানি থমথমে হয়ে গেল। কমান্ড্যান্ট কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে থেকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে, মেয়ে?”
টিশা কাঁপা গলায় বলল, “আমার নাম টিশা। আমার আইডি সাত সাত দুই নয়…”
টিশাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই কমান্ড্যান্ট জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেন এই প্রশ্নটি করেছ? তোমার উদ্দেশ্য কী?”