এর আগে তথ্য জমা করে রাখা কিংবা তথ্য ব্যবহার করার ব্যাপারটা ছিল কঠিন, তাই তথ্যটুকু নির্দিষ্ট ছিল অল্প কিছু ক্ষমতাশালী মানুষের জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে নেটওয়ার্কিং এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে, যে কোনো মানুষই তথ্য পেতে শুরু করল। তখন মানুষের মাঝে ধীরে ধীরে একটা খুব বড় পরিবর্তন ঘটে গেল। এর আগে মানুষ তথ্য জমা রাখত তার মস্তিষ্কে, সেটা প্রক্রিয়া করত তার মস্তিষ্কে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে দেখা গেল মানুষ তথ্য রাখা কিংবা প্রক্রিয়া করার জন্য মস্তিষ্ক ব্যবহার করে না। সবকিছুই মানুষ করে যন্ত্র দিয়ে, কম্পিউটার নামের সেই যন্ত্রটি তখন আর যন্ত্র নেই, তার বুদ্ধিমত্তা আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষণা তখন মানুষ নিজেরা করে না, বুদ্ধিমান কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে করে। একজন মানুষ কতটুকু ক্ষমতাশালী সেটা নির্ভর করে তার কোয়ান্টাম কম্পিউটারে কতটুকু অধিকার তার উপর। আগে সোনা রুপা হীরা ছিল মূল্যবান সম্পদ, তখন সম্পদ হয়ে গেল কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষমতা।
মানুষে মানুষে এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। ইতিহাসে সব সময়েই দেখা গেছে একদল মানুষ চেষ্টা করেছে অন্য দলের মানুষকে দমন করে রাখতে–এখানেও সেটা শুরু হয়ে গেল। প্রথমে যুদ্ধ শুরু হলো এক দেশের কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে অন্য দেশের কোয়ান্টাম কম্পিউটার দখল করে নেওয়ার জন্য। সেটা করার জন্য কাউকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আক্রমণ করতে হয় না–নেটওয়ার্কের ভেতর দিয়ে এক দেশের কোয়ান্টাম কম্পিউটার অন্য দেশে আক্রমণ করতে শুরু করে।
তথ্যের জন্য মানুষ নিজের মস্তিষ্কের উপর নির্ভর না করে তখন নেটওয়ার্ক আর কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উপর নির্ভর করতে শুরু করে। সেটি ছিল মানুষের প্রথম নির্বুদ্ধিতা। এক দেশের পক্ষ থেকে
অন্য দেশের উপর আক্রমণ করার জন্য মানুষ যখন নিজেদের পরিকল্পনার উপর নির্ভর না করে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উপর নির্ভর করতে শুরু করে সেটি ছিল দ্বিতীয় নির্বুদ্ধিতা।
মানুষকে এই নির্বুদ্ধিতার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রথমে একে অন্যকে ধ্বংস করেছে। মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজ, শিক্ষা, গবেষণা, চিকিৎসা, খাবার, আশ্রয় সবকিছুর জন্য এই কম্পিউটার আর নেটওয়ার্কের উপর নির্ভর করত। হঠাৎ করে তাদের সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল। মানুষ রোগে শোকে অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে লাগল। পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা কমতে কমতে অর্ধেক থেকেও নিচে নেমে এল, তখন সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটি ঘটতে শুরু করে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিজে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একে অন্যের উপর নিউক্লিয়ার বোমা ছুঁড়তে শুরু করে। দেখতে দেখতে পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়। বিচ্ছিন্নভাবে এখানে সেখানে কিছু মানুষ বেঁচে থাকে–সারা পৃথিবীতে এখন কতজন মানুষ আছে সেটিও কেউ জানে না। কয়েক হাজার নাকি কয়েক লক্ষ, নাকি কয়েক কোটি সে কথা কেউ বলতে পারে না।
কমান্ড্যান্ট যখন তার কথা শেষ করল তখন আমরা সবাই নিঃশব্দে বসে রইলাম। ঠিক কী কারণ জানা নেই আমাদের কেমন যেন এক ধরনের আতঙ্ক হতে থাকে। সামনের দিকে বসে থাকা কমবয়সী একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল, “এখন কী হবে?”
।কমান্ড্যান্টের মুখটা এতক্ষণ কেমন জানি থমথমে হয়ে ছিল। এই প্রথমবার সেখানে আমরা একটু হাসির চিহ্ন দেখতে পেলাম। কমান্ড্যান্ট হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমি খুব আনন্দের সাথে তোমাদেরকে বলতে চাই, প্রায় কয়েক বৎসরের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার পর আমরা প্রথমবার আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে যাচ্ছি।”
কমবয়সী ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে?”
কমান্ড্যান্ট বলল, “মানুষ যে নির্বুদ্ধিতা করেছিল আমরা সেই নির্বুদ্ধিতা থেকে সরে এসেছি। মানুষ তার মস্তিষ্ক ব্যবহার না করে সকল সিদ্ধান্ত নিত কম্পিউটার নামক যন্ত্র দিয়ে, নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। আমরা মানুষের মস্তিষ্ক আবার ব্যবহার করতে শুরু করেছি, তোমরা নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছ তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে
তুলে ভাবে ছিল আমরা করে কুশ, মিকি আর ক্রিটন। তাদের মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানো হয়েছে, সেই ক্রেনিয়াল ব্যবহার করে আমরা সেখানে বিশাল তথ্যের সম্ভার ঢুকিয়ে দিয়েছি। তারা ইচ্ছে করলে সেই তথ্য ব্যবহার করে যে কোনো কাজ করতে পারবে।”
কমান্ড্যান্ট চোখ নাচিয়ে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস না করলে তোমরা নিজেরা প্রশ্ন করে যাচাই করে নিতে পার।”
কেউ প্রশ্ন করল না। কোনো কিছু নিয়ে প্রশ্ন করতে হলে সেটা সম্পর্কে কিছু জানতে হয়। আমরা কিছুই জানি না, কী নিয়ে প্রশ্ন করব?
কমান্ড্যান্ট আবার বলল, “করো। প্রশ্ন করো।”
খুব ইতস্তত করে মাঝামাঝি জায়গা থেকে একজন প্রশ্ন করল, “চিমটি দিলে ব্যথা লাগে কেন?”
প্রশ্নটি শুনে অনেকেই হেসে উঠল, কুশ, মিকি আর ক্রিটন হাসল। মিকি গম্ভীর হয়ে বলল, “আমাদের সারা শরীরে স্নায়ুর একটা বিশাল নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে আছে। এই পুরো নেটওয়ার্ক কেন্দ্রীভূত হয়েছে আমাদের মস্তিষ্কে। আমাদের মস্তিষ্কে দশ হাজার কোটি নিউরন। এক নিউরন অন্য নিউরনের সাথে…”
মিকি যন্ত্রের মতো কঠিন কঠিন বৈজ্ঞানিক কথা বলতে থাকল। নানারকম সংখ্যা, নানারকম জটিল জটিল নাম, নানারকম সূত্র, নানারকম গবেষণার ইতিহাস–যার বেশির ভাগ আমরা বুঝতেই পারলাম না। অল্প কিছুদিন আগেই মিকি ছিল আমাদের মতো খুবই সাধারণ একটা ছেলে, এখন সে রীতিমতো একজন জ্ঞানী মানুষ। কী আশ্চর্য!