লিংলিকে ধরিয়ে দিয়ে ক্রেনিপিউটার ধ্বংস করার জন্য এই শহরের মানুষেরা আমাকে আর টিশাকে গভীর এক ধরনের ভালোবাসা দিয়ে গ্রহণ করেছিল। কমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে পার্কে পানির ধারে বসে আমরা অনেক গল্প-গুজব করে নেচে গান গেয়ে সময় কাটিয়েছি। ঠিক কী কারণ জানা নেই কিন্তু এত আনন্দে থাকার পরও আমার আর টিশার ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতার জন্ম নিল। অস্থিরতাটুকু আরো বেড়ে গেল যখন মায়ী মায়ীর দস্যুদল শহরটিতে হানা দিল।
তবে দস্যুদলের এই আক্রমণটুকু ছিল খুবই বিস্ময়কর, কারণ দস্যুদলের নেতা এখন আর মায়ী মায়ী নয়–দস্যুদলের নতুন নেতা আমাদের রিয়ানা! এই দস্যুদল এখন শহরে শহরে আক্রমণ করে লুটপাট করে না, কাছাকাছি সবাই মিলে কনসার্টের আয়োজন করে, সবাইকে গান শোনায়। তাদের মূল গায়ক হচ্ছে মায়ী মায়ী। নেচে কুদে সে যখন গান গায় দৃশ্যটি দেখার মত। এরকম একটা বিচিত্র পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব আমি আর টিশা রিয়ানাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। রিয়ানা বলেছে তার মূলে ছিল আমাদের দিয়ে আসা নিউট্রাল ক্রেনিয়াল টিউবটি! সেটা দিয়ে সে একজন একজন দস্যুকে ভালো মানুষে তৈরি করে নিয়েছে। এখনো তাদের বিশাল অস্ত্রসম্ভার, এখনো তারা দরকার হলে অন্য দস্যুদলের সাথে যুদ্ধ করে, কিন্তু সেটি করা হয় শুধু মাত্র জোর করে তাদের ক্রেনিয়ালে নিউট্রাল টিউব ঢুকিয়ে ভালো মানুষ করে ফেলার জন্য। কী আশ্চর্য!
রিয়ানা আমাদের দুজনকে তাদের দলে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, আমরা বিনয়ের সাথে সেটি প্রত্যাখ্যান করেছি, কিন্তু আমাদের ভেতর অস্থিরতাটুকু আরো বেড়ে গেছে। বিশাল কনসার্ট করে রিয়ানার দল চলে যাবার পর একদিন আমি আর টিশা ঠিক করলাম আমরাও চলে যাব। আমরা ঠিক করেছিলাম যাযাবর হয়ে ঘুরে বেড়াব, সেটাই ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত।
আমাদের কেউ চলে যেতে দিতে চাইছিল না কিন্তু যখন বুঝতে পারল আমরা আসলেই চলে যাব, তখন শহরের মানুষেরা একদিন আমাদের দুজনকে বিদায় দিল।
আমি আর টিশা যখন দরকারি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আমাদের মোটর বাইকে বসেছি তখন হঠাৎ করে লক্ষ করলাম, সোনালি চুলের একটি মেয়ে তার বাইকে করে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটিকে আমরা ভালোভাবে চিনি, হাসিখুশি ছটফটে মেয়ে, খুব সুন্দর গান গাইতে পারে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
মেয়েটি মুখের উপর থেকে তার সোনালি চুলগুলো পেছনে সরিয়ে বলল, “তোমাদের সাথে।”
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “আমাদের সাথে?”
“হ্যাঁ।” মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, “আমিও যাযাবর হয়ে যাব।”
“তুমিও যাযাবর হয়ে যাবে?”
মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আমি একা না। ঐ তাকিয়ে দেখো।”
আমি পেছনে তাকালাম, দেখলাম, অসংখ্য তরুণ-তরুণী মোটর বাইকে করে আসছে, এরা সবাই আমাদের সাথে যাযাবর হয়ে যেতে চায়!
.
এই কমবয়সী তরুণ-তরুণীগুলোকে নিয়ে আমরা নিজেরা একটা আনন্দময় শহর গড়ে তুলেছি। সবাইকে নিয়ে থাকতে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করেছি প্রত্যেকটা ছেলে কিংবা মেয়ে নিজের মতন, মানুষের ভেতরকার এই বৈচিত্র্যটাই মনে হয় মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি। সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য।
ছেলেমেয়েগুলো সবাই আলাদা, কারো সঙ্গে কারো কোনো মিল নেই। শুধু একটা ব্যাপারে সবার মাঝে একটা মিল আছে।
এখানে কারো মাথায় কোনো ক্রেনিয়াল নেই!