লিংলি আগে গুলি করেছে নাকি মানুষটি লিংলির মাথায় আগে আঘাত করেছে আমরা জানি না, কিন্তু গুলির শব্দের সাথে সাথে দেখতে পেলাম লিংলি হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে গেল। গুলিটা আমাদের গায়ে লাগল না। ছাদের কোথাও আঘাত করে কিছু প্যানেল ভেঙ্গে নিচে এসে পড়ল। ধাতব দণ্ড হাতে মানুষটি কিছুক্ষণ লিংলির অচেতন দেহের দিকে তাকিয়ে থাকল তারপর টিশার দিকে তাকিয়ে বলল, “মেয়ে, তোমার নামটি ভুলে গেছি।”
“টিশা।”
“টিশা, তুমি যখন বলেছিলে আমাদের সবাইকে মুক্ত করবে তখন আমি তোমার কথা বিশ্বাস করিনি। তোমাকে আমি যথেষ্ট গুরুত্ব দিইনি, তুমি কিছু মনে করো না। আমাকে মাফ করে দিয়ো।”
টিশা কোনো কথা বলল না। মানুষটি বলল, “টিশা, মা, তোমার মতো আমার একটি মেয়ে ছিল।”
টিশা জিজ্ঞেস করল, “সে কোথায়?”
“জানি না, একদিন হারিয়ে গেল।”
লিরিনা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে একটু এগিয়ে এসে বলল, “তোমার মেয়ে হারিয়ে যায়নি।”
মানুষটি চমকে উঠল, বলল, “সে কোথায়?”
লিরিনা বলল, “সে এখানেই আছে। সবার হারিয়ে যাওয়া ছেলে আর মেয়ে এখানে আছে।”
মানুষটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “তুমি কেমন করে জান?”
লিরিনা বলল, “আমি জানি। আমি এখানে কাজ করেছি। আমাকে ডিটিউন করার আগে আমি লিংলির সহকারী ছিলাম।”
আমরা হঠাৎ করে বাইরে অনেক মানুষের কোলাহল শুনতে পেলাম। ক্রেনিপিউটার ধ্বংস হবার পর মানুষ হঠাৎ করে কিছু একটা বুঝতে পেরেছে। তারা সবাই আসছে।
আমি টিশার দিকে তাকালাম, টিশা আমার দিকে তাকাল, ফিসফিস করে বলল, “আমাদের কাজ শেষ।”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ টিশা। আমাদের কাজ শেষ।”
১৫. লিংলির তৈরি করা ক্রেনিপিউটার
শেষ পর্ব
১৫.
লিংলির তৈরি করা ক্রেনিপিউটারে ঝুলিয়ে রাখা মানুষদের একজন একজন করে নামিয়ে তাদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। জ্ঞান ফিরিয়ে আনার আগে খুব সাবধানে তাদের মস্তিষ্ক থেকে বাই ক্রেনিয়াল খুলে নিতে হয়েছিল। কাজটি খুব সহজ ছিল না, সেটি করার সময় দুজন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা গেছে। প্রায় দশজনের মস্তিষ্কের কম-বেশি ক্ষতি হয়েছে–অন্যেরা বেশ ভালোভাবেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে। ক্রেনিপিউটারে একটা প্রসেসর হিসেবে কাজ করার সময়টুকুর কোনো স্মৃতি তারা মনে করতে পারে না–এক দিক দিয়ে সেটি ভালো। সেই বিভীষিকার স্মৃতি দিয়ে তারা কী করবে?
শহরের অনেক মানুষের রহস্যময়ভাবে হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের এখানে খুঁজে পাওয়া গেছে। লিরিনার কথা সত্যি। লিংলির বন্দিশালার মধ্যবয়স্ক মানুষটিও তার মেয়েকে খুঁজে পেয়েছে। আমি আর টিশা আমাদের শহরের লুক আর হুনাকেও খুঁজে পেয়েছি, সত্যি কথা বলতে কি, প্রথমে আমরা তাদের চিনতে পারিনি, মাথায় চুল নেই, বিবর্ণ চেহারা, বিভ্রান্ত দৃষ্টি। হাসপাতালের সারি সারি বিছানায় তারা শুয়ে ছিল, আমাদের দেখে তাদের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। টিশা অবাক হয়ে বলল, “তোমরা লুক আর হুনা না?”
দুজনেই তখন খুবই দুর্বল, কথা বলার শক্তি নেই, তার মাঝে মাথা নাড়ল। টিশা তাদের হাত ধরে বলল, “তোমাদের আর কোনো ভয় নেই। শুধু তোমরা যে বেঁচে যাবে তাই নয়–আমাদের শহরের সব ডিটিউন করা ছেলেমেয়েও ভালো হয়ে যাবে। তাদেরকে কেমন করে ভালো করা যায় আমরা এখন জানি।”
লুক আর হুনা কোনো কথা বলল না, শুধু তাদের চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
শহরের মানুষজন যখন বিজ্ঞানী লিংলির তৈরি করা ক্রেনিপিউটার দেখতে পেল তখন তারা বিস্ময়ে এবং আতঙ্কে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। তাদের শহরে এত ভয়ংকর একটি ঘটনা ঘটছে অথচ তারা কিছু জানে না। এ নিয়ে শহরের মানুষজনের ভেতর তীব্র এক ধরনের অপরাধবোধের জন্ম নিয়েছিল। শহরের মানুষ দাবি করল, বিজ্ঞানী লিংলিকে প্রকাশ্যে সবার সামনে বিচার করে শাস্তি দিতে হবে।
শেষ পর্যন্ত অবশ্যি তাকে বিচার করতে হয়নি কিংবা শাস্তিও দিতে হয়নি। সে নিজেই নিজের শাস্তি দিয়েছিল। তার সেলের ভেতর ছাদ থেকে একটা কার্বন ফাইবার ঝুলিয়ে গলায় ফাঁস নিয়েছিল। সূক্ষ্ম ফাইবার তার গলার চামড়া কেটে বসে যে বীভৎস দৃশ্য তৈরি করেছিল, তার সাথে হয়তো তার নিজের তৈরি ক্রেনিপিউটারেরই শুধু মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আত্মহত্যা করার আগে আমি আর টিশা একবার তার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম, সে খুব স্বাভাবিকভাবে আমাদের সাথে কথা বলেছে, ক্রেনিপিউটারের জন্য তার মনে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ক্রেনিপিউটারে মানুষগুলোকে কেন কার্বন ফাইবার দিয়ে শূন্যে ঝুলিয়ে রেখেছিল। সে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, অল্প জায়গায় অনেক মানুষকে রাখার সেটা সবচেয়ে সহজ উপায়। ঝুলে থাকে বলে চারদিক থেকে আলো বাতাস পায় এবং দেহটি সুস্থ থাকে, বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে চামড়ায় পচন ধরে না। তার কথা শুনে আমি আর টিশা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
আমাদের শহরের মানুষেরা আমাকে আর টিশাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। সবকিছু শুনে তারা আমাদেরকে সেই শহরের কমান্ড্যান্টের দায়িত্ব দিতে চায়। আমরা রাজী হইনি, শুধু মাত্র ডিটিউন করা ছেলে মেয়েগুলোকে ঠিক করে দেয়ার জন্যে একটা নিউট্রাল টিউব পাঠিয়ে দিয়েছি। কুনিল ঠিক হয়ে তার মায়ের সাথে কথা বলছে, ব্যাপারটা চিন্তা করেই আমরা এক ধরনের আনন্দ পাই।