আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখলাম। তারপর টিশার দিকে তাকিয়ে বললাম “টিশা।”
“বলো রিহি।”
“আমরা এখন কী করব?”
“মানুষগুলোর বাই-ক্রেনিয়াল থেকে ক্যাবলগুলো খুলে নিতে হবে।”
“এতগুলো মানুষ, একটা একটা করে খুলতে অনেক সময় নেবে। তা ছাড়া—”
“তা ছাড়া কী?”
আমি বললাম, “বাই-ক্রেনিয়ালগুলো অন্যরকম, মনে হয় মস্তিষ্কের ভেতর পাকাপাকিভাবে কানেকশন দেওয়া-টান দিয়ে মনে হয় না খোলা যাবে।”
টিশা কাছাকাছি ঝুলে থাকা একজন মানুষকে ভালো করে পরীক্ষা করে বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ। এখানে কানেকশন পাকাপাকিভাবে দেওয়া।”
“তাহলে কী করব?”
“মনে হয় ইলেকট্রিক কানেকশনটা খুঁজে বের করে সেটা নষ্ট করতে হবে।”
আমি বিশাল হলঘরটার দিকে তাকালাম, অসংখ্য মানুষের মাথা থেকে বাই-ক্রেনিয়াল কানেকশন দিয়ে ইলেকট্রিক তারগুলো বের হয়ে এসেছে, কোনটা কোনদিকে গিয়েছে বোঝার উপায় নেই। এখান থেকে কানেকশন বের করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। আমি তারপরও চেষ্টা করতে থাকি। ঝুলিয়ে রাখা মানুষগুলোর মাথা থেকে বের হওয়া ইলেকট্রিক ক্যাবলগুলো কোনদিকে গিয়েছে খুঁজে বের করে সেটাকে লক্ষ করে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলাম।
তখন লিরিনা আমাকে থামাল, বলল, “রিহি।”
“বলো লিরিনা।”
“তোমরা আমাকে দুই মিনিট সময় দাও, আমি এই নেটওয়ার্কের সেন্ট্রাল নোডটা বের করে দিই।”
“তুমি পারবে?”
“অন্য সময় হলে পারতাম না। এখন মনে হয় পারব।”
লিরিনা মানুষগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকে, তারগুলো লক্ষ করে, মনে মনে কিছু হিসাব করে তারপর হেঁটে হেঁটে মাঝামাঝি একটা জায়গায় থেমে গিয়ে আমাদের ডাকল। বলল, “টিশা আর রিহি। এদিকে এসো।”
আমরা ঝুলন্ত মানুষগুলোর ফাঁক দিয়ে হেঁটে লিরিনার কাছে গেলাম। লিরিনা হাত দিয়ে দেয়ালের একটা চতুষ্কোণ বাক্স দেখিয়ে বলল, “এই যে এখানে সবগুলো তার এসেছে। এটা হচ্ছে সেন্ট্রাল নোড।”
টিশা বলল, “তার মানে এখান থেকে সবার মস্তিষ্কে সিগন্যাল পাঠানো হয়, আবার সবার মস্তিষ্ক থেকে সিগন্যাল নিয়ে এখানে জমা করা হয়? প্রক্রিয়া করা হয়?”
“হ্যাঁ।”
“তার মানে এটা ধ্বংস করলে পুরো ক্রেনিপিউটার ধ্বংস হয়ে যাবে?”
“হ্যা! মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রেখে ক্রেনিপিউটার ধ্বংস করার এটাই সবচেয়ে সহজ উপায়।”
টিশা এবারে কোনো কথা না বলে হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তুলে ধরে দেয়ালের চৌকোনা বাক্সটা লক্ষ করে গুলি করতে শুরু করে। প্রথম গুলিতেই সেটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল কিন্তু টিশা থামল না, হিংস্র মুখে সেটাকে গুলি করতে থাকল এবং গুলির ভয়ংকর শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে হলঘরে ফিরে আসতে থাকল।
আমি টিশার ঘাড়ে হাত রেখে বললাম, “টিশা, থামো। এটা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। আর কেউ এটাকে ঠিক করতে পারবে না।”
টিশা থামল, আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল, “এখন আমার মরে গেলেও দুঃখ নেই।”
আমি বললাম, “না টিশা। এখন মরে যেতে পারবে না। এই মানুষগুলোকে বাঁচাতে হবে। লিংলিকে ধরিয়ে দিতে হবে। তারপর বলতে পার, মরে গেল দুঃখ নেই। এর আগে মরে গেলে অনেক দুঃখ থাকবে।”
কে যেন গমগমে গলায় বলল, “তোমাদের সেই দুঃখ নিয়েই মারা যেতে হবে।”
আমরা চমকে উঠলাম, মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি বিজ্ঞানী লিংলি, তার হাতে একটা বেঢপ অস্ত্র। আমাদের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না তোমরা আমার এত বড় ক্ষতি করতে পেরেছ। পুরো শহরটা এই ক্রেনিপিউটার নিয়ন্ত্রণ করত–এখন পুরো শহরটা নিয়ন্ত্রণহীন। তোমাদের জন্য।” হিংস্র গলায় চিৎকার করে বলল, “শুধু তোমাদের জন্য।”
আমি হাতের অস্ত্রটা সোজাসুজি লিংলির দিকে তাক করে বললাম, “আমি কখনো কোনো মানুষ খুন করিনি। সব সময়েই মনে হতো কাজটা খুব কঠিন। কিন্তু বিজ্ঞানী লিংলি–কিংবা দানব লিংলি, তোমাকে খুন করার জন্য গুলি করতে আমার হাত এতটুকু কাঁপবে না।”
লিংলি বলল, “তাতে কিছু আসে যায় না নির্বোধ ছেলে। তোমাদের অস্ত্র থেকে এখন কোনো গুলি বের হবে না, আমি এইমাত্র সেইগুলো অকেজো করে দিয়েছি। বিশ্বাস না করলে আমাকে গুলি করার চেষ্টা করে দেখ।”
আমি চেষ্টা করলাম, খট করে একটা শব্দ হলো কিন্তু আর কিছু হলো না। বিজ্ঞানী লিংলি এক পা পিছিয়ে বলল, “এই ছেলে আর মেয়ে, তোমরা আমার মানুষগুলোর সামনে থেকে সরে এসো। আমি যখন গুলি করব তখন মানুষগুলোর কোনো ক্ষতি করতে চাই না। আমাকে আবার ক্রেনিপিউটার দাঁড় করাতে হবে। মানুষগুলো আমার দরকার।”
আমি আর টিশা যেখানে ছিলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। লিংলি বলল, “ঠিক আছে। তাহলে যেখানেই আছ সেখানেই থাকো, আমি ট্রাংকিউলাইজার দিয়ে গুলি করি। যখন তোমাদের জ্ঞান হবে তখন দেখবে, আমার ক্রেনিপিউটারের মানুষগুলোর পাশে তোমরা দুজনও কার্বন ফাইবারের তার দিয়ে ছাদ থেকে ঝুলছ।”
লিংলির মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে এবং সে তার মুখের ভয়ংকর হাসিটি ধরে রেখে ট্রিগারে হাত দিল। আমি আর টিশা স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বিজ্ঞানী লিংলি দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু আমরা দেখছি খোলা দরজা দিয়ে আমাদের সাথে থাকা মানুষগুলো নিঃশব্দে ঢুকছে। সবার সামনে থাকা মাঝবয়সী মানুষটির হাতে একটা ধাতব দণ্ড, সে পেছন থেকে লিংলির মাথায় আঘাত করার জন্য দণ্ডটি মাথার উপরে তুলেছে।