ছোট ঘরটিতে ঢোকার পর দরজাটা নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেল–সেটি একদিক থেকে ভালো, হঠাৎ করে কেউ চলে এলে আমাদের দেখতে পাবে না।
সামনে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, দূর থেকে আমাদের কেউ দেখছে কি না বুঝতে পারছিলাম না। দেখতে পেলেও কিছু করার নেই। আমাদের কাছে এমন দুটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, দরকার হলে ছোটখাটো যুদ্ধ করা যাবে।
টিশা লিরিনাকে সামনের দরজাটা দেখিয়ে বলল, “লিরিনা, তোমাকে এই দরজাটা খুলে দিতে হবে।”
লিরিনা একটু ইতস্তত করে বলল, “কীভাবে?”
“দরজার প্যানেলে পাসওয়ার্ডটি ঢোকাতে হবে।”
লিরিনা দুর্বলভাবে হেসে বলল, “পাসওয়ার্ডটি আমাকে বের করতে হবে?”
টিশা মাথা নেড়ে তার পকেট থেকে একটা ক্রেনি-টিউব বের করে তার কোডটি পড়ে নিশ্চিত হয়ে বলল, “তোমার ক্রেনিয়ালে এটা ঢোকানো হলে তুমি অসাধারণ একজন গণিতবিদ হয়ে যাবে। তখন হয়তো পাসওয়ার্ডটি বের করতে পারবে।”
“যদি না পারি?”
“তাহলে আমাদের অস্ত্র দিয়ে গুলি করে দরজা ভেঙে ফেলব। কিন্তু আগেই সেটা করতে চাই না। যত সম্ভব কম হৈ চৈ করে
ক্রেনিপিউটারে ঢুকতে চাই।”
লিরিনা বলল,”ঠিক আছে, বানাও আমাকে গণিতবিদ।”
টিশা লিরিনার মাথায় সাবধানে ক্রেনি-টিউবটা ঢুকিয়ে দিল। লিরিনা কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ খুলে তাকাল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সবকিছু ঠিক আছে?”
লিরিনা বলল, “হ্যাঁ ঠিক আছে। কিন্তু বুঝতে পারছি মাথার ভেতর কিছু একটা হয়ে গেছে। সবকিছু কেমন যেন ধোঁয়ার মতো লাগছে। সংখ্যা ছাড়া আর কিছু দেখছি না।”
টিশা লিরিনার হাত ধরে বলল, “আমরা মোটেও তোমাকে এই অবস্থায় বেশিক্ষণ রাখব না। তুমি একটু চেষ্টা করে দেখো পাসওয়ার্ডটি ডিকোড করতে পার কি না–যদি না পার ক্ষতি নেই, এক্ষুনি আবার তোমার মাথায় নিউট্রাল টিউব দিয়ে তোমাকে ঠিক করে দেব।”
লিরিনা কোনো কথা বলল না, ভুরু কুঁচকে দরজার প্যানেলের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে-মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে এবং মুখটি কেমন যেন লালচে হয়ে আসতে থাকে। সে দুই হাত দিয়ে তার মাথার চুলে হাত ঢুকিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করতে থাকে এবং তাকে দেখে আমাদের কেমন যেন ভয় করতে থাকে।
টিশা বলল, “লিরিনা, তোমার কী কষ্ট হচ্ছে? তাহলে থাকুক আমরা গুলি করে দরজা ভেঙে ফেলি।”
লিরিনা বলল, “না, আগে একটু চেষ্টা করে দেখি।”
লিরিনা দরজার সামনে গিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। সে কিছুক্ষণ সংখ্যার প্যানেলটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর সেটার উপর আলতো করে হাত বুলালো। তারপর হঠাৎ প্রায় ঝড়ের বেগে কিছু সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে আবার কিবোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইল, হাত দিয়ে স্পর্শ করল এবং চোখ বন্ধ করে ফেলল। এরপর চোখ বন্ধ অবস্থাতেই সে প্যানেলের কিবোর্ডে খুব দ্রুত কিছু সংখ্যা প্রবেশ করায়, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর আবার কিবোর্ডে সংখ্যা প্রবেশ করায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, আবার দ্রুত কিছু সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে ভারী দরজার মাঝে কান লাগিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করে।
টিশা বলল, “তুমি কী করছ লিরিনা? যদি সমস্যা হয় বলো, গুলি করে দরজা ভেঙে ফেলি।”
লিরিনা কথা শুনতে পেল কি না বুঝতে পারলাম না। সে কিছুক্ষণ দরজাটার দিকে তাকিয়ে খুব সাবধানে একটা একটা করে সংখ্যা প্রবেশ করাতে থাকে এবং কী আশ্চর্য হঠাৎ করে দরজাটা খুলে যায়। সাথে সাথে লিরিনাও মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে গেল।
আমি আর টিশা ছুটে গিয়ে লিরিনাকে ধরলাম, টিশা আতঙ্কিত হয়ে ডাকল, “লিরিনা! লিরিনা!”
লিরিনা চোখ খুলে তাকাল, ফিসফিস করে বলল, “আমাকে একটু বিশ্রাম নিতে দাও।”
আমরা ভয় পাচ্ছিলাম দরজাটা না আবার বন্ধ হয়ে যায়। দরজাটা বন্ধ হলো না এবং লিরিনা কয়েক সেকেন্ড পর উঠে বসে বলল, “চলো, যাই।”
টিশা বলল, “তোমার ক্রেনিয়ালে নিউট্রাল টিউব দিয়ে তোমাকে ঠিক করে দিই?”
লিরিনা বলল, “আগে ভেতরে ঢুকে যাই, তারপর।”
আমরা ভেতরে ঢুকে গেলাম এবং তিনজন একসাথে আর্তনাদ করে উঠলাম।
.
ভেতরে বিশাল একটা হলঘর এবং সেখানে অসংখ্য মানুষের নগ্ন দেহ ছাদ থেকে ঝুলছে। সূক্ষ্ম এক ধরনের তার দিয়ে শরীরটাগুলো ঝোলানো হয়েছে, দেখে মনে হয় বুঝি মানুষগুলো শূন্যে ঝুলছে। মানুষগুলোর মাথার পেছন থেকে ইলেকট্রিক ক্যাবল বের হয়ে এসেছে। তাদের নাকের ভেতরে এক ধরনের নল। মুখের ভেতরে আরেকটি নল এবং শরীরের ভেতরে নানা জায়গায় ছোট-বড় নল লাগানো। কোনো কোনো নলের ভেতর দিয়ে শরীরের ভেতর এক ধরনের তরল পদার্থ ঢুকে যাচ্ছে। কোনো কোনো নলের ভেতর দিয়ে তাদের শরীর থেকে কিছু একটা বের করে নেওয়া হচ্ছে। হলঘরে যন্ত্রের এক ধরনের চাপা গুঞ্জন এবং সবচেয়ে যেটি ভয়ংকর সেটি হচ্ছে তীব্র এক ধরনের অপরিচিত অস্বস্তিকর গন্ধ।
আমরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, মনে হতে লাগল বুঝি ভুল করে নরকের ভেতর এসে ঢুকে পড়েছি। ছাদ থেকে তার দিয়ে ঝোলানো মানুষগুলোর মুখে যন্ত্রণার এক ধরনের অভিব্যক্তি। তাদের চোখ বন্ধ, কিন্তু মাঝে মাঝেই তাদের চোখ খুলে যাচ্ছিল কিন্তু সেই চোখে তারা কিছু দেখছিল বলে মনে হয় না। হঠাৎ হঠাৎ তাদের সারা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছিল এবং মাঝে মাঝে তাদের গলা দিয়ে ঘর ঘর করে এক ধরনের শব্দ বের হচ্ছিল। যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত মানুষের দেহ। নারী-পুরুষ এবং কিশোর-কিশোরী। তাদের শরীরে একধরনের অপুষ্টির চিহ্ন, গায়ের রং বিবর্ণ। কারো মাথায় কোনো চুল নেই।