মানুষগুলো মাথা নাড়ল। বলল, “ঠিক আছে। আমরা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব।”
কিছুক্ষণের ভেতর আমি আর টিশা লিরিনাকে নিয়ে দরজার কাছে গেলাম। গার্ডের কার্ডটি দরজার সামনে ধরতেই দরজা খুলে গেল।
আমরা ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে এলাম। ভারী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা ঘাড়ে নিয়ে আমি আর টিশা লিরিনার পিছু পিছু হাঁটতে থাকি।
সামনে কী আছে জানি না। কী হবে তাও জানি না। হঠাৎ করে মনে হতে থাকে কী হবে তাতে কিছু আসে যায় না! আমাদের চেষ্টা করতে হবে–চেষ্টা করার একটা সুযোগ এসেছে।
১৪. আমাদের যে ঘরটিতে আটকে রেখেছে
আমাদের যে ঘরটিতে আটকে রেখেছে তার বাইরে একটা ছোট করিডোর, করিডোরটাতে আধো আলো এবং আধো অন্ধকার। করিডোরের দুই মাথায় যতদূর চোখ যায় কোনো গার্ড নেই। লিংলির এই ক্রেনিপিউটার প্রোজেক্টটি এত নৃশংস এবং অমানবিক যে, সে এটি কারো কাছে প্রচার করতে পারে না। সে যা করতে চায় সেটি গোপনে করতে হয়, তাই খুব বেশি মানুষের সাহায্য নিতে পারে না। নিরাপত্তার জন্য সে মানুষ থেকে বেশি নির্ভর করে যন্ত্রপাতির উপর। মানুষ যাদেরকে রেখেছে তাদের বেশির ভাগকেই ডিটিউন করে রেখেছে। এই ডিটিউন করা মানুষগুলো তাদেরকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া একটি-দুটি কাজ ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। এইমাত্র আমরা একটা প্রহরীকে কাবু করে এসেছি, এই প্রহরীটি পুরোপুরি ডিটিউন করা নয়, কিন্তু তারপরেও পুরোপুরি স্বাভাবিক মানুষ মনে হয়নি। সে একটিবারও একটি শব্দ উচ্চারণ করেনি।
লিরিনা করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে, তার ঠিক পেছনে টিশা এবং তার থেকে কয়েক পা পেছনে আমি। আমি অস্ত্রটাকে শক্ত করে ধরে রেখেছি, সামনে থেকে হঠাৎ কেউ এলে সে আমাকে অস্ত্র হাতে দেখতে পাবে না এবং আমি কিছু একটা করার সময় পাব।
আমরা লম্বা করিডোর ধরে হেঁটে শেষ মাথায় পৌঁছে যখন লিরিনার পিছু পিছু ডান দিকে হাঁটতে শুরু করেছি ঠিক তখন দেখতে পেলাম, সামনে দিয়ে একজন হেঁটে আসছে। আমি চমকে উঠলাম এবং আমার বুকটা ধক করে উঠল, আমি অস্ত্রটা উঁচু করে ধরলাম, যদি গুলি করতে হয় গুলি করব, কিন্তু আমি কখনো কোনো মানুষকে গুলি করিনি। মানুষকে হত্যা করা মোটেও সহজ কিছু নয়।
লিরিনা বলল, “ভয় নেই। এটি একজন ডিটিউন করা মানুষ।” আমি বুকে আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে অস্ত্রটা নিচে নামিয়ে আনি। ডিটিউন করা মানুষটি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল।
আমরা আরো দুটি করিডোর পার হয়ে সামনে এগিয়ে যাবার সময় প্রথমবার আরেকজন সশস্ত্র প্রহরীর দেখা পেলাম। মানুষটি লিরিনাকে দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হয়েছিল কিন্তু তার পেছনে টিশাকে আর আমাকে দেখে চমকে উঠল। কোনো কথা না বলে সে তার অস্ত্রটা আমাদের দিকে তাক করে ধরল, টিশা ফিসফিস করে বলল, “গুলি কর রিহি।”
আমি কাঁপা গলায় বললাম, “আমি কখনো কোনো মানুষকে গুলি করিনি।”
টিশা বলল, “কোনো ভয় নেই। তোমার অস্ত্রটি কোনো মানুষকে মেরে ফেলবে না। এটা ট্রাংকিউলাইজারে সেট করা। মানুষটি অচেতন হয়ে যাবে।”
আমি আর দেরি না করে গার্ডটাকে গুলি করলাম, “ধুপ” করে একটা চাপা শব্দ হলো আর সাথে সাথে মানুষটা একটু কেঁপে উঠে একটা আর্ত শব্দ করল। এক ধরনের বিস্ফারিত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ঘুরে গিয়ে হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে গেল।
টিশা ছুটে গিয়ে গার্ডের গলায় ঝোলানো ব্যাজটা খুলে নিয়ে তার অস্ত্রটা হাতে নিয়ে বলল, “চমৎকার! এখন আমাদের দুটি অস্ত্র! আরো একজন গার্ডের সাথে দেখা হলে আমাদের তিনটি অস্ত্র হয়ে যাবে, আমরা তখন পুরোপুরি সশস্ত্র একটা দল হয়ে যাব।”
আমি বললাম, গার্ডটাকে লুকিয়ে ফেলা দরকার। টিশা বলল, “কোথায় লুকাবে?”
লিরিনা বলল, “কাছেই একটা ইউটিলিটি ঘর আছে, আমরা সেখানে লুকিয়ে ফেলতে পারি।”
তখন আমরা ধরাধরি করে গার্ডটাকে ইউটিলিটি ঘরে লুকিয়ে ফেলে আবার তিনজন হাঁটতে শুরু করলাম। আমি টিশাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার অস্ত্রটা যে ট্রাংকিউলাইজারে সেটা করা সেটা তুমি কখন দেখলে?”
টিশা বলল, “আমি দেখিনি।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “তাহলে?”
“আমি অনুমান করেছিলাম, জীবিত মানুষ লিংলির কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। লিংলি কখনোই কাউকে মেরে ফেলতে চাইবে না। তাই ধরে নিয়েছিলাম অস্ত্রটা নিশ্চয়ই ট্রাংকিউলাইজারে সেটা করা থাকবে।”
“যদি না থাকত?”
“তাহলে একটু আগে তুমি জীবনে প্রথম একটা মানুষ খুন করতে। বিপদের সময় অনেক কিছু করতে হয়।”
আমি কোনো কথা বললাম না। টিশা খুবই বিচিত্র মেয়ে, তাকে বোঝা খুব কঠিন।
লিরিনা আমাদেরকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে একটা খাড়া দেয়ালের সামনে হাজির হলো। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা ক্রেনিপিউটার।”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু এখানে ঢুকব কেমন করে?”
লিরিনা বলল, “জানি না।”
টিশা খুব মনোযোগ দিয়ে দেয়ালটি লক্ষ করে, সেটার উপরে হাত বুলায় কিন্তু ভেতরে ঢোকার মতো কিছু খুঁজে পায় না। তখন একটু আগে গার্ডের গলায় ঝোলানো যে ব্যাজটি টিশা খুলে এনেছে সেটা দেয়ালের উপর রেখে ডানে বামে নাড়তে থাকে এবং হঠাৎ করে ঘরঘর শব্দ করে দেয়ালটি সরে গিয়ে ভেতরে ছোট একটি ঘর বের হয়ে আসে। টিশার মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, “চমকার।”