একটু অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিলাম, হঠাৎ দেখলাম সবাই এক ধরনের আনন্দের শব্দ করে উঠে দাঁড়িয়েছে, আমিও তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালাম। হলঘরের সামনে উঁচু স্টেজে আমাদের শহরের কমান্ড্যান্ট এসে হাজির হয়েছে, তার সাথে কুশ, মিকি আর ক্রিটন। আমরা আনন্দে হাততালি দিতে থাকি। কুশ, মিকি আর ক্রিটনের বয়স ষোলো হয়ে গেছে, তাই তাদের মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানোর জন্য নিয়ে গিয়েছিল। অনেকদিন তাদের দেখিনি। আজকে কমান্ড্যান্ট তাদেরকে নিয়ে এসেছে। তাদের সাথে লুক আর হুনাও ছিল, এই দুজনকে দেখতে পাচ্ছি না, আমি তাদের দেখার জন্য মাথা উঁচু করে আশেপাশে তাকাতে লাগলাম কিন্তু খুঁজে পেলাম না।
“নেই। আর কেউ নেই।” কানের কাছে কেউ একজন ফিসফিস করে কথা বলছে, আমি মাথা ঘুরে তাকালাম, কখন টিশা এসে দাঁড়িয়েছে আমি লক্ষ করিনি।
আমি টিশার দিকে তাকালাম, টিশা নিচু গলায় বলল, “লুক আর হুনা নেই।”
“কোথায়? ওরা কোথায়?”
টিশা তার ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল, “শ-স-স-স, প্রশ্ন করা নিষেধ।”
আমরা কমান্ড্যান্টের গমগমে গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, “আমার প্রিয় সন্তানেরা। কমিউনের সভায় তোমাদের আমন্ত্রণ!”
কমান্ড্যান্ট একটু থামল, আমরা জোরে জোরে হাততালি দিলাম। কমান্ড্যান্ট যখন কথা বলে তখন মাঝে মাঝে হাততালি দিতে হয়।
কমান্ড্যান্ট বলল, “আজ আমাদের খুব আনন্দের দিন! আজ কুশ, মিকি আর ক্রিটন তোমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অল্প কিছুদিন আগেও এই তিনজন ছিল অন্য দশজনের মতো কমবয়সী সাধারণ ছেলে আর মেয়ে। এখন তারা এই শহরের মূল্যবান নাগরিক। দায়িত্বশীল নাগরিক। তাদের মাথায় এখন ক্রেনিয়াল লাগানো হয়েছে, মানুষের সঞ্চিত জ্ঞান ভান্ডারের সাথে যোগাযোগ করে যখন খুশি তারা যে কোনো জ্ঞান জেনে নিতে পারবে।”
কমান্ড্যান্ট আবার থামল, যার অর্থ আবার আমাদের চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করতে হবে, হাততালি দিতে হবে। আমরা চিৎকার করলাম, হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করলাম। আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম টিশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি গলা নামিয়ে তাকে বললাম, “টিশা! হাততালি না দিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
টিশা কিছু না বলে একদৃষ্টে সামনে তাকিয়ে রইল। কমান্ড্যান্ট আবার কথা বলতে শুরু করল, “তোমরা সবাই জান আজ থেকে একশ বছর আগে পৃথিবীর সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এটি মনে হয়, সভ্যতার নিয়ম, একেবারে উঁচুতে উঠে সেটা ধ্বংস হয়ে যায়। প্রাচীনকালে সভ্যতা ছিল বিচ্ছিন্ন, তাই তারা বিচ্ছিন্নভাবে ধ্বংস হতো। এক প্রান্তে সভ্যতা ধ্বংস হওয়ার পর অন্য প্রান্তে সভ্যতা গড়ে উঠত। কিন্তু একশ বছর আগে যখন পৃথিবীর সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল সেটি ছিল একটি পরিপূর্ণ ধ্বংসলীলা। তোমরা কি কেউ বলতে পারবে, কেন এটি ছিল একটি পরিপূর্ণ ধ্বংস প্রক্রিয়া?”
আমরা কেউ কিছু জানি না, আমাদের জানার কোনো উপায় নেই। নিজেরা নিজেরা মাঝে মাঝে কথা বলি, তার মাঝে কোনো তথ্য থাকে না, নানারকম গুজব থাকে। তাই আমরা কমান্ড্যান্টের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না। তারপরও দেখলাম সামনের দিকে বসে থাকা লাল চুলের একজন কমবয়সী মেয়ে উত্তর দেবার চেষ্টা করল, বলল, “কারণ শেষ যুদ্ধে এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে নিউক্লিয়ার বোমা ব্যবহার করেছিল।”
কমান্ড্যান্টের মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে, সে হাততালি দিয়ে বলল, “চমৎকার! তোমার উত্তরটি পুরোপুরি ঠিক নয়, কিন্তু তারপরও তোমাকে অভিনন্দন। তোমার মাথায় কোনো ক্রেনিয়াল নেই, তারপরও তুমি নিউক্লিয়ার বোমার কথা জান! তোমাকে অভিনন্দন।”
লাল চুলের মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কেন সারা পৃথিবীর সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেল?”
কমান্ড্যান্ট গম্ভীর মুখে বলল, “কারণটি মানুষের নির্বুদ্ধিতা।” কথাটি শেষ করে কমান্ড্যান্ট থেমে গেল, কাজেই আমরা সবাই বিস্ময়ের মতো শব্দ করলাম, জিজ্ঞেস করলাম, “নির্বুদ্ধিতা?”
কমান্ড্যান্ট মুখটি আরো গম্ভীর করে বলল, ”হ্যাঁ নির্বুদ্ধিতা। তোমরা কি সেই নির্বুদ্ধিতার ইতিহাস শুনতে চাও?”
আমরা চিৎকার করে বললাম, “শুনতে চাই, শুনতে চাই।” শুধু টিশা কোনো কথা না বলে সামনে তাকিয়ে থেকে বিড় বিড় করে বলল, “কিন্তু লুক আর হুনা কোথায় গেল?” তার কথাটা আমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পেল না।
কমান্ড্যান্ট তখন এই পৃথিবীতে মানবসভ্যতা ধ্বংসের ইতিহাস বলতে শুরু করল। কমান্ড্যান্টের গলার স্বর গমগমে, কথা বলার ধরনটিও ভালো, আমরা সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনতে থাকি। তার কথার সারমর্মটি এরকম:
পৃথিবীতে সভ্যতার একটা বিস্ফোরণ শুরু হয়েছিল প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগে। মোটামুটিভাবে বলা যায় এই নতুন সভ্যতার পেছনে ছিল একটা যন্ত্র, ভুল করে তার নাম দেওয়া হয়েছিল কম্পিউটার–অর্থাৎ যেটা দিয়ে হিসাব করা হয়। দেখা গেল এই যন্ত্রটি আসলে অন্যরকম। এর আগে যতবার কোনো যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে, সেটি সব সময়ে একটা নির্দিষ্ট কাজ করেছে-কিন্তু কম্পিউটার নামক যন্ত্রটা কোনো নির্দিষ্ট কাজের জন্য তৈরি হয়নি, এটা যে কোনো কাজে ব্যবহার করা যেত। যন্ত্রটার আকার ধীরে ধীরে ছোট হতে শুরু করল এবং এক সময় সেটা সম্ভাব্য অসম্ভাব্য সব জায়গায় ব্যবহার হতে শুরু করল।