টিশা একটু এগিয়ে গার্ডটার মাথায় হাত রাখল, গার্ডটা তখন অবিকল কুকুরের মতো কুঁই কুঁই শব্দ করে টিশার পায়ের কাছে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল। টিশা গার্ডটার গলায় ঝোলানো কার্ডটা খুলে নিল, পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেখানে যা যা আছে পরীক্ষা করার জন্য বের করে আনল।
আমি এগিয়ে একটা প্লেট নিয়ে তার মাঝে কিছু খাবার দিয়ে সেটা গার্ডটার সামনে ঠেলে দিলাম। গার্ডটা উঠে বসে দুই হাত এবং পায়ে ভর দিয়ে বসে খাবারগুলো চেটে চেটে খেতে শুরু করল। দৃশ্যটি অস্বস্তিকর-তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে কেমন যেন শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
.
ঘরের মাঝে এত কিছু ঘটেছে কিন্তু ডিটিউন করা মেয়েটি তার কিছুই লক্ষ করল না। সে খাবারের কার্টের সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েই রইল, ডানে বা বামে একবার ঘুরেও তাকাল না। আমি টিশাকে বললাম, “টিশা এই ডিটিউন করা মেয়েটিকে ঠিক করার চেষ্টা করা যাক।”
টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। চেষ্টা করে দেখি, কাজ করবে কি জানি না।”
আমি ক্রেনি-টিউবগুলো থেকে নিউট্রাল টিউবটা বের করে টিশার দিকে এগিয়ে দিলাম। টিশা টিউবটা হাতে নিয়ে ডিটিউন করা মেয়েটির কাছে গিয়ে তার হাতটি ধরল। মেয়েটি টিশার দিকে না তাকিয়েই অন্য হাতটি দিয়ে টিশার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। টিশা তাকে ছাড়ল না তাকে ধরে রেখে ক্রেনি টিউবটি তার মাথার পিছনে ক্রেনিয়ালে ঢুকিয়ে দিল। সাথে সাথে মেয়েটির সারা শরীর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থর থর করে কাঁপতে শুরু করে। মনে হতে থাকে সে বুঝি মেঝেতে লুটিয়ে পড়বে। আমি ছুটে গিয়ে তার অন্য হাতটা ধরে তাকে পড়ে যেতে দিলাম না। মেয়েটির চোখ বন্ধ হয়ে আসে এবং শব্দ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। আমরা তখন সাবধানে তাকে মেঝেতে বসিয়ে দিলাম। মেয়েটি নিজের হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ধীরে ধীরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
আমি আর টিশা কী করব বুঝতে পারলাম না। নিউট্রাল টিউবটি ক্রেনিয়ালে লাগিয়ে মেয়েটিকে ঠিক করা গেছে, নাকি আরো খারাপ কিছু হয়ে গেছে আমরা বুঝতে পারছিলাম না। আমি আর টিশা মেয়েটির দুই পাশে বসে অপেক্ষা করতে থাকি।
মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এক সময় মুখ তুলে তাকাল এবং সাথে সাথে আমরা বুঝে গেলাম মেয়েটি আর ডিটিউন করা বোধ শক্তিহীন একটি মানুষ নয়। তার চোখে সেই ভয়ংকর শূন্য দৃষ্টি নেই। তার চোখে এক ধরনের বিস্ময়, কৌতূহল এবং বিষণ্ণতা। আমাদের দিকে তাকাল তারপর ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “আমি কোথায়?”
টিশা বলল, “তুমি আমাদের সাথে আছ।”
মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা?”
টিশা বলল, “আমার নাম টিশা আর ও হচ্ছে রিহি। তোমার নাম কী?”
মেয়েটা বলল, “এক সময়ে আমার নাম ছিল লিরিনা।”
টিশা বলল, “লিরিনা, তোমার কী হয়েছিল মনে আছে?”
লিরিনা নামের মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, “মনে আছে।”
“কী মনে আছে?”
লিরিনা কেমন জানি শিউরে উঠল, বলল, “মনে আছে আমি বিজ্ঞানী লিংলির সাথে কথা বলছি, ঝগড়া করছি, আমি তাকে বলছি, তুমি যত বড় বিজ্ঞানীই হও, তুমি এটা করতে পার না।”
“কী করতে পার না?”
“মানুষকে ব্যবহার করে ক্রেনিপিউটার বানানো।”
“তারপর?”
“তারপর আমাকে ধরে নিয়ে গেল একটা অপারেশন থিয়েটারে। সেখানে আমাকে কী করল আর মনে নেই।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি জান ক্রেনিপিউটারটা কোথায়?”
লিরিনা এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ জানি। করিডোর ধরে হেঁটে গেলে একেবারে শেষে।”
“সেখানে পাহারা আছে?”
“না, কোনো মানুষ পাহারা দেয় না। কিন্তু কেউ ভেতরে যেতে পারে না। দরজায় পাসওয়ার্ড দেওয়া আছে।”
টিশা মাথা নাড়ল, আমি চিন্তিত মুখে বললাম, “আমরা কেমন করে ভেতরে যাব?”
টিশা বলল, “নীল সবুজ চার চার তিন দুই।”
আমি একটু চমকে উঠলাম, নীল সবুজ চার চার তিন দুই হচ্ছে একজন সুপার গণিতবিদের ক্রেনিটিউব। টিশার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই ক্রেনি-টিউব দিয়ে কী পাসওয়ার্ড ভাঙা যাবে?”
“চেষ্টা করতে দোষ কী? লিরিনার ক্রেনিয়ালে লাগাব।”
লিরিনা একটু অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “আমার মাথায় কী লাগাবে?”
টিশা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “তোমাকে আমাদের একটু সাহায্য করতে হবে। তুমি কি সাহায্য করবে?”
লিরিনা একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, “তোমরা আমাকে ডিটিউন থেকে মুক্ত করেছ, অবশ্যই তোমাদের সাহায্য করব। আমাকে কী করতে হবে বলো।”
“আমাদের ক্রেনিপিউটারের কাছে নিয়ে যাবে। তারপর তোমার ক্রেনিয়ালে একটা ক্রেনি-টিউব লাগিয়ে ক্রেনিপিউটারের কোড ভেঙে আমাদের ভেতরে ঢোকানোর ব্যবস্থা করে দেবে।”
“আমি পারব?”
“নিশ্চয়ই পারবে!”
“ঠিক আছে তাহলে। কখন যেতে চাও?”
“এখনই। দেরি করতে চাই না।”
লিরিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো তাহলে যাই।”
টিশা উঠে দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা যাচ্ছি। আমাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করো যেন আমরা ক্রেনিপিউটার ধ্বংস করে আসতে পারি।”
মানুষগুলো এখন আর আগের মতো হতাশ আর নির্জীব নয়। একজন বলল, “আমি তোমাদের সাথে যেতে চাই।”
তখন এক সাথে অনেকেই বলে উঠল, “আমরাও যেতে চাই।”
আমি বললাম, “এখনই সবার যাওয়া ঠিক হবে না। বাইরে কী আছে আমরা জানি না। আগে আমরা যাই। প্রয়োজন হলে পরে তোমাদের নিতে আসব।”