টিশা বলল, “হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ।”
এখানে যারা আছে মানসিকভাবে সবাই এত বিপর্যস্ত যে তাদের ভেতরে কোনো ধরনের আগ্রহ কৌতূহল বা অনুভূতি নেই। তাদেরকে কিছু বলার জন্য ডেকে একত্র করা যাবে বলে মনে হয় না। তাই টিশা
তার চেষ্টা করল না, সে হলঘরের মাঝখানে একটা চেয়ার এনে তার উপর দাঁড়িয়ে রইল।
ঘরে যারা ছিল তারা ধীরে ধীরে টিশার সামনে জড় হলো। যখন বেশ কয়েকজন এসে একত্র হয়েছে তখন টিশা গলা উঁচিয়ে বলল, “তোমরা কারা কারা এখান থেকে বের হতে চাও?”
যারা সামনে দাঁড়িয়েছিল তারা কেমন যেন চমকে উঠল, একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, তারপর ঘুরে টিশার দিকে তাকাল। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলল না। টিশা বলল, “তাহলে তোমরা কেউ এখান থেকে বের হতে চাও না?”
মধ্য বয়স্ক একজন বলল, “তুমি নিশ্চয়ই তামাশা করছ। তোমার মতো একজন বাচ্চা মেয়ে আমাদেরকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবে?”
টিশা এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”
“কীভাবে?”
“আমি এখন সেটা তোমাদের বলব না। তোমরা নিজেরাই দেখবে। তবে–”
“তবে কী?”
“আমরা যখন আমাদের কাজ শুরু করব, তোমরা এমন কিছু করবে না যার জন্য আমাদের ঝামেলা হয়।”
পেছনে দাঁড়ানো একজন বলল, “তুমি এখানে যা বলছ তার সবকিছু বাইরে থেকে দেখছে, বাইরে থেকে শুনছে। এক্ষুনি কেউ এসে তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে।”
টিশা বলল, “না। নেবে না।”
“তুমি কেমন করে জান?”
“আমি জানি। আমি পরীক্ষা করেছি। এই ঘরটি গোপন ঘর–বিজ্ঞানী লিংলি ছাড়া আর কেউ এই ঘরের খবর রাখে না।”
টিশা তার চেয়ার থেকে নেমে আবার হলঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। আমি তার পাশে গিয়ে বসার পর টিশা আমাদের ব্যাগটা খুলে ব্যাগের লাইনিংগুলোর ভেতর লুকানো ক্রেনি-টিউবগুলো বের করল। আমরা সেখান থেকে খুঁজে খুঁজে কুকুরের ক্রেনি-টিউবটি বের করে আলাদা করে রাখলাম। টিশা সেটা তার পকেটে ভরে নেয়, তারপর আমরা অপেক্ষা করতে থাকি।
কী হবে আমরা জানি না, এক ধরনের উত্তেজনায় আমার বুকটা ধক ধক করতে থাকে।
ঘণ্টা খানেক পর দরজাটা খুলে গেল, ডিটিউন করা মেয়েটি এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে খাবারের কার্টটা ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসতে থাকে। তার পেছনে সশস্ত্র গার্ডটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি আলগোছে ধরে রেখে একটু এগিয়ে আসে। কয়েকজন খাবার নেওয়ার জন্য কার্টের কাছে এগিয়ে যায়। আমিও তাদের সাথে এগিয়ে গেলাম, সশস্ত্র গার্ডটির কাছে গিয়ে আমি হঠাৎ ঘুরে গার্ডটির হাতে ধরে রাখা অস্ত্রটি খপ করে ধরে ফেলোম।
সশস্ত্র গার্ডটি এর জন্য প্রস্তুত ছিল না, তাকে দেখে মনে হলো সে ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি অস্ত্রটি ছাড়লাম না, সেটা ধরে রেখে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। গার্ডটিও তার অস্ত্রটি ছাড়ল না–স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ঝটকা মেরে আমার হাত থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করল। এক ধরনের হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল, কিন্তু এরকম অবস্থায় যেটা খুবই স্বাভাবিক-চিৎকার এবং চেঁচামেচি সেটা হলো না। আমি মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করলাম না আর গার্ডটিও এতটুকু উত্তেজিত হলো না, মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করল না। আমাদের আশেপাশে যারা ছিল তারা সরে গেল এবং আমি চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেলাম টিশা ক্রেনি-টিউবটি হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে।
টিশাকে সাহায্য করার জন্য আমি গার্ডের পায়ে লাথি মেরে নিচে পড়ে গেলাম, গার্ডটাও আমার উপর পড়ে গেল। অস্ত্রটি আমার বুকের উপর চেপে বসেছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু আমি সব সহ্য করে দুই হাতে অস্ত্রটি ধরে নিশ্চল হয়ে রইলাম। গার্ডটি অস্ত্রটি ছিনিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু উঠতে পারছে না। আমি দেখলাম ক্রেনি-টিউবটা হাতে নিয়ে টিশা গার্ডটির পেছনে দাঁড়িয়েছে। তারপর ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে গার্ডের মাথার ক্রেনিয়ালে টিউবটি ঢুকিয়ে দিল।
গার্ডটি প্রথমবার যন্ত্রণার একটা তীব্র চিৎকার করে উঠল, তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। গার্ডটি ধরে রাখা অস্ত্রটি ছেড়ে দিয়ে আমার উপর থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। দুই হাত আর দুই পা ভাঁজ করে বুকের কাছে এনে গার্ডটি কাঁপতে থাকে। আমি অস্ত্রটি হাতে নিয়ে গার্ডটির দিকে তাক করে ধরে রাখলাম।
আমাদের আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো দূরে সরে গিয়েছিল, এবার তারা আস্তে আস্তে কৌতূহলী চোখে কাছে এগিয়ে আসে। তাদের মুখ দেখে বোঝা যায় তারা এখনো পুরো বিষয়টা বিশ্বাস করতে পারছে না।
গার্ডটির কাঁপুনি ধীরে ধীরে থেমে যায়, তখন আস্তে আস্তে সে উঠে বসে, হাত এবং পায়ে ভর দিয়ে পশুর মতো সে একটু ঘুরে আসে, নাক দিয়ে মাটিতে পুঁকে তারপর উপরের দিকে মুখ করে অবিকল কুকুরের মতো শব্দ করে করুণ সুরে ডেকে ওঠে। চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই অবিশ্বাসের শব্দ করে পেছনে সরে যায়। টিশা সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন তোমাদের বিশ্বাস হয়েছে?”
একজন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? এর কী হয়েছে?”
টিশা বলল, “কিছু হয়নি। ওর মাথায় কুকুরের সিস্টেম লোড করা হয়েছে। মানুষটার সাথে এখন একটা কুকুরের কোনো পার্থক্য নেই। গলায় দড়ি বেঁধে কোথাও আটকে রাখ।”