আজকে দুপুরবেলা যখন ডিটিউন করা বিষণ্ণ তরুণীটি এবং তাকে পাহারা দিয়ে নিষ্ঠুর চেহারার সশস্ত্র মানুষটি খাবার নিয়ে এল তখন টিশা হলঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে অন্যমনস্কভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি টিশাকে খুব ভালো করে চিনি তাই আমি বুঝতে পারলাম টিশা মোটেও অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে নেই, সে তীক্ষ্ণ মনোযোগ দিয়ে এই দুজনকে দেখছে, সে কিছু একটা ভাবছে, কিছু একটা পরিকল্পনা করছে।
আমার অনুমান সত্যি, কারণ ঘণ্টা খানেক পর যখন ডিটিউন করা তরুণীটি খাবারের কার্ট ঠেলে ঠেলে বের হয়ে গেল তখন টিশা আমাকে ডাকল, বলল, “রিহি, আমি কি তোমার সাথে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি?”
আমি টিশার পাশে বসে বললাম, “কী বিষয় নিয়ে কথা বলবে?”
“বিজ্ঞানী লিংলিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আমি কিছু একটা করতে চাই।”
শুনে আমি চমকে উঠলাম। কয়েক সেকেন্ড আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। টিশা বলল, “বিজ্ঞানী লিংলি আমাদেরকে এমনিতেই শেষ করে দেবে। শুধু শুধু তাকে আমাদের শেষ করতে দেব কেন? কোনো একটা ঘরে আমাদের শরীরটা ফেলে রেখে আমাদের মস্তিষ্কটা ব্যবহার করবে। কেন তাকে আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে দেব? আমি বিজ্ঞানী লিংলিকে আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে দেওয়ার চেয়ে সেটাকে থেঁতলে নষ্ট করে দেব।”
আমি কিছুক্ষণ টিশার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, “তুমি কী করতে চাও?”
“প্রথমে এই ঘর থেকে বের হতে চাই।”
“কেমন করে বের হবে?”
“এখান থেকে বের হওয়ার একটাই পথ। ডিটিউন করা মেয়েটা আর সশস্ত্র মানুষটা যখন এখানে আসবে তখন তাদের কাবু করে আমরা এখান থেকে বের হয়ে যাব।”
আমি ভয় পাওয়া গলায় বললাম, “কাবু করে?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি কাবু করতে পারবে?”
“আমি একা করব না। তুমি আমাকে সাহায্য করবে।”
“আমরা দুজন মিলে কাবু করব?”
টিশা মুখ শক্ত করে বলল, “হ্যাঁ আমরা দুজনে মিলে চেষ্টা করব। কেন সবকিছু চেষ্টা না করে ছেড়ে দেব?”
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “আর কী চেষ্টা করবে?”
“এখান থেকে বের হয়ে ক্রেনিপিউটারটা খুঁজে বের করব। তারপর সেটা ধ্বংস করব।”
“ধ্বংস করতে পারবে?”
টিশা বিচিত্র একটা ভঙ্গিতে একটু হেসে বলল, “একটা জিনিস তৈরি করা খুব কঠিন, সেটাকে ধ্বংস করা খুব সোজা।”
আমি মাথা নাড়লাম, মনে হয় টিশা খুব ভুল কথা বলেনি। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “আমরা দুজন কি অস্ত্র হাতের মানুষটা কাবু করতে পারব?”
টিশা বলল, “কেন পারব না? তুমি একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছ কেন?”
“কী জিনিস?”
“মনে নেই মায়ী মায়ীর বাক্স থেকে আমরা কতগুলো ক্রেনিয়াল টিউব চুরি করে এনেছি? এর মাঝে একটা হচ্ছে কুকুরের টিউব। সেই টিউব ক্রেনিয়ালে লাগিয়ে দিতেই মানুষটা চোখের পলকে কুকুর হয়ে যায় মনে আছে?”
“হ্যাঁ, মনে আছে।”
“তার মানে বুঝেছ?”
আমি তখনো টিশা কী বলতে চাচ্ছে বুঝিনি, মাথা নেড়ে বললাম, “বুঝিনি।”
“তার মানে কেউ যদি সাহায্য নাও করে শুধু তুমি আর আমি মিলে মানুষটাকে কাবু করতে পারব।”
আমি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, “কীভাবে?”
“মনে করো, তুমি গিয়ে তার অস্ত্রটা খপ করে ধরে ফেললে, কিছুতেই ছাড়বে না, মানুষটা তখন অস্ত্রটা তোমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করবে। যখন হুটোহুটি হতে থাকবে তখন আমি পেছন থেকে তার মাথার ক্রেনিয়ালে ঘ্যাচ করে কুকুরের টিউবটা ঢুকিয়ে দেব। সেকেন্ডের মাঝে ভয়ংকর সশস্ত্র গার্ড হয়ে যাবে একটা নেড়ি কুকুর।”
আমি চিন্তা করে দেখলাম, টিশা খুব ভুল কথা বলেনি। আমাদের কাছে যে বেশ কয়েকটা ক্রেনি-টিউব আছে সেটা কেউ জানে না। আমরা যে পেছন থেকে কারো ক্রেনিয়ালে একটা ক্রেনি-টিউব ঢুকিয়ে দিতে পারি সেটা কেউ সন্দেহ করবে না। আমি মাথা নেড়ে বললাম, “তোমার বুদ্ধিটা খারাপ না টিশা। খুবই বিপজ্জনক কিন্তু খারাপ না।”
টিশা বলল, “যে কোনো বুদ্ধি বিপজ্জনক! তা ছাড়া এখন বিপদের ভয় করার সময় চলে গেছে।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ডিটিউন করা মেয়েটি নিয়ে কী করবে?”
“ঐ মেয়েটি তো কিছু বোঝে না, তাকে নিয়ে তো কোনো ভয় নেই।”
আমি একটু চিন্তা করে বললাম, “আমাদের কাছে বেশ কয়েকটা ক্রেনি-টিউব আছে, তাই না?”
“হ্যাঁ আছে।”
“তার মাঝে একটা নিউট্রাল টিউব রয়েছে মনে আছে?”
টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “মনে আছে। আমরা রিয়ানাকে একটা দিয়েছিলাম।”
“হ্যাঁ। ঐ নিউট্রাল টিউবটা যদি আমরা ডিটিউন করা মেয়েটার মাথায় লাগিয়ে দিই তাহলে কী হবে? সে কি ঠিক হয়ে যাবে?”
টিশাকে মুহূর্তের জন্য একটু বিভ্রান্ত দেখায়, তারপর মাথা নেড়ে বলল, “তুমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছ রিহা। একজনকে ডিটিউন করার সময় তার মস্তিষ্কের ভেতর কী করে আমরা জানি না, যদি সেটা অক্ষত থাকে তাহলে নিউট্রাল টিউব দিয়ে নিশ্চয়ই ঠিক করা যাবে! রিহি, তুমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছ! যদি এটা কাজ করে তাহলে আমরা সব ডিটিউন করা মানুষকে ঠিক করে ফেলতে পারব।”
“তার আগে আমাদের এখান থেকে বের হতে হবে।”
“হ্যাঁ।” টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “আগে এখান থেকে বের হতে হবে।”
আমি তখন আশেপাশের সব মানুষকে দেখিয়ে বললাম, “আমার মনে হয় আমরা কী করতে চাচ্ছি সেটা সবাইকে জানিয়ে রাখা ভালো। তারা আমাদের সাহায্য যদি নাও করে বাধা যেন না দেয়।”