বিজ্ঞানী লিংলির মুখে খুব ধীরে ধীরে একটা হাসি ফুটে উঠল। মানুষের মুখের হাসির মতো বিচিত্র আর কিছু পৃথিবীতে আছে কি না আমার জানা নেই। কোনো কথা না বলে শুধু মুখের হাসি দিয়ে কত কিছু প্রকাশ করে ফেলা যায়! লিংলি তার মুখের হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল যে, এই পৃথিবীতে তার থেকে ভয়ংকর আর নিষ্ঠুর মানুষ আর একটিও নেই! তার কাছে পনের বছর দুই মাস এগার দিনের একটা মেয়ের কোনো মূল্য নেই। নিজের প্রয়োজনে সে টিশার মতো শত শত মানুষকে যেভাবে প্রয়োজন সেভাবে ব্যবহার করবে।
বিজ্ঞানী লিংলি তার মুখের ভয়ংকর হাসিটি ধরে রেখে বলল, “টিশা! আমি তোমাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছি! তুমি যদি আমার ল্যাবরেটরি কমপ্লেক্সের ক্রেনিপিউটার বিল্ডিংয়ের চোদ্দ তলায় আটকা না থাকতে, তাহলে তুমি সবার জন্য একটা বিপজ্জনক মানুষ হতে পারতে! কিন্তু তুমি এখন বিপজ্জনক নও। তুমি পুরোপুরি আমার হাতের মুঠোয়। তোমার শরীরের এক দশমিক তিন কেজি ওজনের মস্তিষ্কটুকু ছাড়া আর কোনো কিছুতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমার ক্রেনিপিউটারের দুশ বায়ান্নটি মস্তিষ্কের মাঝে তোমারটাও যুক্ত হবে। শুধু তোমারটা না তোমাদের সাথে যারা আছে তাদের সবার! তোমার চমকার বুদ্ধিদীপ্ত তথ্যবহুল সৃজনশীল তেজস্বী মস্তিষ্কটিকে এক সেকেন্ডে আমি একশ বিলিয়ন নিউরনের একটা হার্ডওয়ারে পাল্টে দেব। তথ্য পাঠাব তোমার মস্তিষ্কে সেই তথ্য প্রক্রিয়া করে আমাকে ফেরত পাঠাবে। তুমি থাকবে না, শুধু তোমার মস্তিষ্কটা থাকবে! বুঝেছ?”
টিশা বলল, “আমি এই সব কথা জানি। তুমি যদি সত্যিই আমাকে কিছু বলতে চাও তাহলে আমি যেগুলো জানি না সেগুলো আমাকে বলো।”
“তুমি কী জান না?”
“যেসব কথা বইয়ে লেখা হয়নি আমি সেগুলো জানি না। তোমার ক্রেনিপিউটার কীভাবে কাজ করে আমি জানি না। মানুষের মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে হলে মানুষটিকে জীবিত থাকতে হয়। এতগুলো মানুষকে জীবিত রাখ কেমন করে সেটা আমি জানি না। তার শরীরের পুষ্টি দরকার–”
“টিশা, তোমার প্রশ্নটা খুবই সঠিক। কীভাবে ক্রেনিপিউটার বানাব আমি অনেক দিন থেকে জানি কিন্তু কীভাবে এতগুলো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, আমি সেটা জানতাম না। টিশা, তুমি শুনে খুব খুশি হবে আমি সেই সমস্যাটা খুবই চমৎকারভাবে সমাধান করেছি। যেদিন তোমাকে ক্রেনিপিউটারে জুড়ে দেব সেদিন তুমি নিজের চোখে দেখবে! দেখে চমৎকৃত হবে!” কথা শেষ করে বিজ্ঞানী লিংলি আনন্দে আবার হা হা করে হাসল!
টিশা হাসি থেমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করল। যখন হাসি থেমে গেল তখন জিজ্ঞেস করল, “মানুষগুলোর মস্তিষ্কের বাই-ক্রেনিয়াল থেকে যে সিগন্যাল আসে সেগুলো তুমি কোথায় প্রক্রিয়া করো?”
বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “আমি সেটা কীভাবে করি পৃথিবীর কেউ জানে না! এটা আমার আবিষ্কার, আমি ছাড়া আর কেউ কখনো জানবে না!”
টিশা মুখ শক্ত করে বলল, “আমি সেটা জানতে চাই। তুমি আমাকে ক্রেনিপিউটারে জুড়ে দিয়ে শুধু আমার স্মৃতি নয়–আমার অস্তিত্বকেও ধ্বংস করে দেবে–আমাকে বলো, আমি জানা না জানায় এখন তোমার কিছু আসে যায় না!”
বিজ্ঞানী লিংলি মাথা নাড়ল, বলল, “না আমি তোমাকে বলব না। যদি বলিও তুমি বুঝবে না।”
“আমি বুঝব। তুমি চেষ্টা করে দেখো।”
“না, আমি বলব না।”
এবারে টিশা খিলখিল করে হেসে উঠল, তার হাসি থামতেই চায়। বিজ্ঞানী লিংলি অবাক হয়ে বলল, “এই মেয়ে, তুমি হাসছ কেন?”
টিশা হাসি থামিয়ে মুখ শক্ত করে বলল, “আমার নাম টিশা।”
বিজ্ঞানী লিংলি খোঁচাটি সহ্য করে বলল, “টিশা, তুমি কেন হাসছ?”
“সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী লিংলি পনের বছর দুই মাস এগার দিনের একটা মেয়ের বুদ্ধিমত্তাকে এত ভয় পায় যে তাকে দুই দিন পরে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলবে জেনেও তাকে কিছু তথ্য জানাতে সাহস পায় না। এটা আমার জন্যে খুবই হাসির ব্যাপার।” টিশা তীব্র দৃষ্টিতে বিজ্ঞানী লিংলির দিকে তাকিয়ে হিংস্র গলায় বলল, “তুমি যত বড় বিজ্ঞানীই হও না কেন লিংলি, তোমার যত ক্ষমতাই থাকুক না কেন, আসলে তুমি একজন দুর্বল মানুষ। তুমি একজন ভীতু কাপুরুষ ছাড়া আর কিছু নও।”
টিশার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই স্বচ্ছ দেয়ালটি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে কালো দেয়াল হয়ে গেল। টিশা যখন মাথা ঘুরিয়ে ভেতরে তাকাল, দেখল, ঘরের ভেতরের সব কয়জন মানুষ স্থির চোখে টিশার দিকে তাকিয়ে আছে।
তাদের চোখে ভয় আতঙ্ক আর বিস্ময়। তবে চোখের দৃষ্টিতে সবচেয়ে যেটা বেশি, সেটা হচ্ছে অবিশ্বাস।
১৩. সকালবেলা আরো তিনজন মানুষ
সকালবেলা আরো তিনজন মানুষ আমাদের সাথে যোগ দিল, তাদের সবার চোখে-মুখে এক ধরনের দিশেহারা ভাব। তারা কোথা থেকে এসেছে, কেমন করে এসেছে সেটি নিয়ে কারো মাঝে কোনো কৌতূহল নেই। সবাই এক ধরনের স্থির নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল, আমিও মনে হয় একইভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনজন খুবই ব্যাকুলভাবে সবার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করল, কেউ তাদের কথার উত্তর দেবার চেষ্টা করল না–কারণটি সহজ, উত্তর দেবার মতো সে রকম কিছু নেই।
দুপুরবেলার দিকে আমাদের জন্য একজন ডিটিউন করা তরুণী খাবার নিয়ে এল। খাবারের কার্টটা ঠেলে ঠেলে সে হলঘরের মাঝখানে এনে রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আমরা দেখেছি, একেবারে নিঃশব্দে সে ঘণ্টা খানেক দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর খালি কার্টটাকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে বের হয়ে যায়। ডিটিউন করা এই তরুণীটির পেছনে পেছনে একজন সশস্ত্র মানুষ থাকে, এই মানুষটি তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি সবার দিকে তাক করে রাখে। এই মানুষটি ডিটিউন করা নয়, কিন্তু তবু সে কারো সাথে কথা বলে না। মানুষটির মুখে এমন একটা নিষ্ঠুরতার ছাপ রয়েছে যে কেউ তার সাথে কথা বলার সাহস করে না।