“কী খাও?”
“একজন ডিটিউন মানুষ খাবার আনে। সাথে একজন গার্ড থাকে। তার হাতে সব সময় অস্ত্র থাকে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।”
আমি কথা বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেলাম না। যে দেয়ালটি মাঝে মাঝে স্বচ্ছ হয়ে যায় আর স্বচ্ছ হবার পর অন্য পাশে লিংলিকে দেখা যায় আমি সেই দেয়ালটিতে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম।
.
দুই দিন পর হঠাৎ করে দেয়ালটি স্বচ্ছ হয়ে গেল। আমি প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম এবং দেখলাম অন্যপাশে বিজ্ঞানী লিংলি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি উত্তেজিতভাবে চিৎকার করে বললাম, “বিজ্ঞানী লিংলি! মহামান্য বিজ্ঞানী লিংলি। আমি রিহি। যাকে তুমি দস্যুদলের কাছ থেকে মুক্ত করেছ!”
বিজ্ঞানী লিংলি আমার কথা শুনতে পেয়েছে কি না বুঝতে পারলাম। সে এক ধরনের অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। হেঁটে পিছনে গেল, পেছনের একটা টেবিল থেকে একটা কাঁচের গ্লাসে কোনো এক ধরনের তরল পানীয় ঢেলে নিল, সেই পানীয়ে চুমুক দিয়ে আবার সামনে এগিয়ে এসে স্বচ্ছ দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি আবার চিৎকার শুরু করলাম, শুধু চিকারের উপর ভরসা না করে আমি এবারে দুই হাত নেড়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে লাগলাম। মনে হলো বিজ্ঞানী লিংলি প্রথমবার আমাকে দেখতে পেল এবং তার চোখে-মুখে এক ধরনের কৌতূহল ফুটে উঠল। সে এগিয়ে গিয়ে কোথায় একটা সুইচ টিপে দেবার পর সে আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, আমিও তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “ছেলে! তুমি এভাবে চিৎকার করছ কেন? তোমার কী হয়েছে?”
আমি বললাম, “মহামান্য লিংলি! তোমার মনে আছে, তুমি আমাকে আর আমার বন্ধু টিশাকে দস্যুদলের কাছ থেকে মুক্ত করেছ? দুই দিন আগে কমিউনের সভায় তোমার সাথে
কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে লিংলি বলল, “মনে আছে। তোমার সমস্যা কী?”
“তুমি বলেছিলে তুমি আমাদের সব দুঃখ কষ্ট দূর করে একটা নতুন জীবন উপহার দেবে!”
“বলেছিলাম নাকি?”
“হ্যাঁ। তুমি কমিউনের মানুষের সামনে”
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বিজ্ঞানী লিংলি হাত নেড়ে পুরো বিষয়টা উড়িয়ে দেবার মতো ভঙ্গি করে বলল, “কমিউনের সভায় অনেক কথা বলতে হয়। তোমাদের মুক্ত করতে অনেক মুক্তিপণ দিতে হয়েছে, সেটি কি শুধু শুধু দিয়েছি?”
আমি একটু হতবুদ্ধি হয়ে বললাম, “তাহলে আমাদের কী করবে?”
“তোমাদের আনা হয়েছে ক্রেনিপিউটার বানানোর জন্য। তোমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল নেই–আমার এরকম মানুষই দরকার। ক্রেনিয়াল দিয়ে মাথায় শুধু তথ্য দেওয়া যায়, তথ্য বের করা যায় না। আমি নতুন ক্রেনিয়াল তৈরি করেছি, সেটা বাই-ক্রেনিয়াল। এটা দিয়ে তথ্য দেওয়া যায় আবার তথ্য বের করে আনা যায়। মাথায় এটা লাগালে–”
বিজ্ঞানী লিংলি হঠাৎ কথা থামিয়ে হা হা করে হাসতে লাগল। এখানে হাসির ব্যাপারটা কোথায় আমি ধরতে পারলাম না। বিজ্ঞানী লিংলি একসময় হাসি থামিয়ে তার পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিল, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে বলল, “আমি তোমাদের কেন এই সব কথা বলছি? তোমাদের মাথায় কোনো ক্রেনিয়াল নেই, তোমরা কিছু শিখো নাই, তোমরা কিছু জানো না, বোঝো না! তোমাদের মানসিক বয়স ছয়-সাত বছরের বেশি নয়, আমি তোমাদের যেসব কথা বলছি সেগুলো তোমাদের বোঝা সম্ভব না! তোমরা হয়তো দুই আর দুই যোগ করলে কত হয় সেটাই জান না!”
এতক্ষণ টিশা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল। এই প্রথম সে কথা বলল, “দুই আর দুই যোগ করলে কত হয় আমরা জানি। শুধু দুই আর দুই নয় প্রাইমভিত্তিক সংখ্যা দিয়ে আমরা যে কোনো সংখ্যা প্রক্রিয়া করতে পারি। ক্রেনিয়াল কীভাবে কাজ করে আমরা সেটা জানি। শহরের মানুষের ক্রেনিয়ালে তথ্য দেবার জন্য তুমি নেটওয়ার্ক ব্যবহার কর, মূল সার্ভার ছাড়া সেখানে তথ্য দেওয়া যায় না কিন্তু দস্যুদলের কাছে অনেক দামে বিক্রি করার জন্য তুমি ক্রেনি-টিউব তৈরি করেছ আমরা সেটাও জানি। বেগুনি নীল তিন তিন দুই চার হচ্ছে এরকম একটা কোড। এই কোডের ক্রেনি-টিউব কী করে আমি সেটাও বলতে পারব।”
বিজ্ঞানী লিংলির চোখ দেখতে দেখতে বিস্ফারিত হয়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথা বলতে পারে না, এমন কী হাতে ধরে রাখা পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিতেও সে ভুলে যায়। একটু পর বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, “তুমি এগুলো কোথা থেকে জেনেছ?”
“প্রাচীন মানুষেরা যেভাবে জানত সেভাবে জেনেছি।”
“মানে?”
“ভিডি টিউবে বই পড়ে জেনেছি। আমি দেখতে চেয়েছিলাম মাথায় ক্রেনিয়াল টিউব না লাগিয়ে শেখা যায় কি না, জানা যায় কি না। আমি এখন জানি এটা সম্ভব। তোমাদের ক্রেনিয়াল প্রযুক্তির কোনো প্রয়োজন নেই। এটা আসলে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা কৌশল।”
বিজ্ঞানী লিংলি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে টিশার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তোমার বয়স কত মেয়ে?”
“আমার নাম টিশা।”
বিজ্ঞানী লিংলি মনে হলো বিশ্বাস করতে পারল না যে কেউ তার সাথে এভাবে কথা বলতে পারে। টিশার সূক্ষ্ম খোঁচাটি সহ্য করে আবার জিজ্ঞেস করল, “টিশা, তোমার বয়স কত?”
“তুমি একটু আগে বলেছ আমাদের মানসিক বয়স ছয়-সাত বছরের বেশি না। আমার ধারণা আমার মানসিক বয়স আরো অনেক বেশি–তোমার সমান যদি নাও হয় তার কাছাকাছি হবে। জৈবিক বয়স পনের বছর। পনের বছর দুই মাস এগার দিন।”