করতে হলো, কোনো চেকপোস্টে ত্বকের পরিত্যক্ত কোষ দিয়ে ডিএনএ টেস্ট করতে হলো।
শেষ চেকপোস্টটা আমাদের পুরো শরীর স্ক্যান করে একটা ঘরে ঢুকতে দিল। প্রথমে টিশা, তার পিছু পিছু আমি। ঘরটাতে ঢোকার সাথে সাথে পিছনের স্বয়ংক্রিয় দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবার সাথে সাথে আমি হঠাৎ করে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করি। কারণ দরজাটির কোনো হাতল নেই, কোনো চাবির গর্ত নেই, মনে হলো ধাতব একটি দেয়াল দিয়ে আমাদের একটা ঘরে বন্দি করে ফেলা হয়েছে। আমি আর টিশা আমাদের ব্যাগ হাতে নিয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলাম, সামনে এগোতেই একটা দরজা খুলে গেল এবং আমরা একটা হলঘরের মতো জায়গায় পৌঁছলাম। হলঘরটির মেঝে এবং দেয়াল ধূসর বর্ণের, দেখে কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়।
আমি বললাম, “আমরা কোথায় এসেছি। এটাকে মোটেও একটা হোস্টেল মনে হচ্ছে না।”
টিশা এবারেও কোনো কথা বলল না, তার হাতের ব্যাগটি নিয়ে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। দেয়ালের কাছাকাছি পৌঁছতেই নিঃশব্দে একটা দরজা খুলে গেল। আমরা সেই দরজা দিয়ে পাশের ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালাম, আমাদের সামনে অনেকগুলো নানা বয়সী মানুষ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ বলে দেয়নি কিন্তু দেখেই বুঝতে পারলাম আমাদেরকে যেভাবে এখানে আনা হয়েছে এই মানুষগুলোকেও ঠিক একইভাবে এখানে আনা হয়েছে।
মানুষগুলো পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি অভিবাদনের ভঙ্গি করে হাত নেড়ে বললাম, “শুভ সকাল।” কী কারণ জানা নেই কথাটা খুবই বেখাপ্পা শোনাল।
মানুষগুলো কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু মনে হলো পেছন থেকে কমবয়সী একজন হাসির মতো শব্দ করল, আনন্দহীন এক ধরনের হাসি। এই হাসিটি শুনে আমি বুঝতে পারলাম সকালটি আর যাই হোক শুভ নয়।
আমি বললাম, “আমার নাম রিহি। আর এ হচ্ছে টিশা।”
ভেবেছিলাম মানুষগুলোর ভেতর থেকে কেউ একজন নিজের পরিচয় দেবে, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলল না। স্থির দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা কারা?”
মানুষগুলো এবারেও কোনো কথা বলল না, আমার মনে হলো। কথা বলবেও না। কিন্তু হঠাৎ করে একজন বলল, “আমরা কারা তাতে কিছু আসে যায় না।”
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “মানে?”
“মানে আমাদের নিজের পরিচয়ের এখন আর কোনো গুরুত্ব নাই। তুমি কে আমি কে তাতে কিছু আসে যায় না। আগে হোক পরে হোক তোমাকে আমাকে সবাইকে দেয়ালের ঐ পাশে চলে যেতে হবে।”
“দেয়ালের ঐ পাশে কী আছে?”
মানুষটা উত্তর দেওয়ার আগেই টিশা বলল, “ক্রেনিপিউটার।”
যারা স্থির দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়েছিল এই প্রথমবার তাদের চোখে এক ধরনের কৌতূহল ফুটে উঠল। একজন টিশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী বললে?”
“আমি বলেছি ক্রেনিপিউটার।”
“তুমি কেমন করে জান ওখানে ক্রেনিপিউটার আছে? আমাদেরকে কেন ক্রেনিপিউটারের ঘরে নিয়ে যাবে?”
টিশা বলল, “তা না হলে কেন আমাদের একজন একজন করে এখানে ধরে এনেছে?”
আমি টিশাকে বাধা দিয়ে বললাম, “তুমি কী বলছ টিশা? আমাদেরকে মোটেও ধরে আনা হয়নি। বিজ্ঞানী লিংলি নিজে বলেছে আমাদের এই ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে দেবে। আমাদের সব দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা শেষ করে দেবে।”
“রিহি! তোমার এবং আমার থেকে বেশি ভালো করে কে জানে যে একজন মানুষের দুঃখ কষ্ট আর যন্ত্রণা দূর করে দেবার জন্য দরকার একটি বেগুনি নীল তিন তিন দুই চার ক্রেনি-টিউব!”
বেগুনি নীল তিন তিন দুই চার কোড নম্বরের ক্রেনি-টিউব মাথায় ঢুকিয়ে দিলে মুহূর্তে একজন মানুষের ভেতর সব দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা উধাও হয়ে ভেতরে এক ধরনের প্রশান্তি নেমে আসে! মায়ী মায়ীর বাক্স থেকে আমরা যে টিউবগুলো চুরি করে এনেছি তার মাঝে এই কোড নম্বরের একটা ক্রেনি-টিউব আছে!
আমি কিছুক্ষণের জন্য টিশার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, “তুমি কি মনে কর বিজ্ঞানী লিংলি আমাদের সাথে মিথ্যা কথা বলেছে?”
“না। বিজ্ঞানী লিংলি মিথ্যা কথা বলেনি। সত্যি কথা বলেছে। আমাদেরকে ল্যাবরেটরি কমপ্লেক্সে এনেছে। এখানে কাজ করতে দেবে–আমাদের সব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যাবে–সব সত্যি। তবে যেভাবে সেটা করা হবে তুমি সেটা পছন্দ করবে কি করবে না সেটা ভিন্ন কথা!”
আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম টিশা যেটা সন্দেহ করেছে সেটা হয়তো সত্যি। হঠাৎ করে আমি এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি। আমাদের পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমাদের সাথে কি বিজ্ঞানী লিংলির দেখা হয়?”
কমবয়সী একজন মেয়ে বলল, “হয়, আবার হয় না।”
“তার মানে কী?”
কমবয়সী মেয়েটি বড় একটা দেয়াল দেখিয়ে বলল, “মাঝে মাঝে এই দেয়ালটা স্বচ্ছ হয়ে যায়। তখন দেয়ালের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানী লিংলি আমাদের দেখে।”
“কী দেখে?”
“আমি জানি না। “
“তোমরা সারাদিন কী কর?”
“কিছু করি না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি, দেখি নতুন কে আসে।”
“প্রতিদিন নতুন মানুষ আসে?”
“আসে আবার চলেও যায়। ধরে নিয়ে যায়। আমাকেও একদিন ধরে নিয়ে যাবে।” মেয়েটা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, “তোমাকেও ধরে নিয়ে যাবে।”
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। শুধুমাত্র কিছু একটা বলার জন্য বললাম, “তোমরা কোথায় ঘুমাও?” মেয়েটা হাত নেড়ে বলল, “এই তো এখানে ঘুমাই।”