আমি আর টিশা চমকে উঠলাম। বিজ্ঞানী লিংলি আমাদের কথা বলছে! আমরা দুজনেই চোখ বড় বড় করে কথাগুলো ভালো করে শোনার চেষ্টা করলাম।
বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “আমি যতদূর জানি সেই কিশোর কিশোরী দুজনকে এই হলঘরে আনা হয়েছে। তারা কোথায়? তোমরা দুজন কি একটু দাঁড়াবে?”
আমি আর টিশা উঠে দাঁড়ালাম এবং হলঘরের সবাই কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর আবার আনন্দের শব্দ করে হাততালি দিতে লাগল।
বিজ্ঞানী লিংলি আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমরা দুজন স্টেজে চলে এসো। তোমাদেরকে একটু সামনাসামনি দেখি। একটু কথা বলি।”
আমার আর টিশার বুক ধক ধক শব্দ করতে লাগল। দুজন সাবধানে সারি সারি চেয়ারের মাঝখানে রাখা জায়গা দিয়ে স্টেজের দিকে এগোতে লাগলাম।
স্টেজে ওঠার পর বিজ্ঞানী লিংলি আমাদেরকে ভালো করে দেখার সুযোগ পেল, আমরাও তাকে ভালো করে দেখার সুযোগ পেলাম। দূর থেকে তাকে সাদামাটা একজন মানুষ মনে হচ্ছিল, কাছে থেকে তাকে দেখে বোঝা যায় মানুষটি সাদামাটা নয়, তার চোখগুলোর দৃষ্টি এত তীব্র যে সেদিকে তাকিয়ে থাকা যায় না।
বিজ্ঞানী লিংলি জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের দুজনের নাম?”
আমরা আমাদের নাম বললাম। বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “তোমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল নেই, বুঝতেই পারছি বয়স এখনো ষোলো হয়নি। এই কম বয়সে পৃথিবীর কোনো বিষয়ে তোমাদের কোনো তথ্য নেই, জ্ঞান নেই, অভিজ্ঞতা নেই–তখন একটা দস্যুদলের হাতে বন্দি! তোমাদের তখন কেমন লাগত?”
আমি বললাম, “খুব খারাপ লাগত। মরে যেতে ইচ্ছে করত।”
বিজ্ঞানী লিংলি মাথা নেড়ে বলল, “না, না। কখনো মারা যাবার কথা বলবে না। একজন মানুষ অনেক বড় একটি ব্যাপার, সে কখনো মরে যাবার কথা বলতে পারে না।”
আমরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “দস্যুদল তোমাদের কী রকম অত্যাচার করত, একটু বলবে?”
আমি টিশার দিকে তাকালাম। টিশা মাথা নাড়ল, ফিসফিস করে বলল, “আমি বলতে চাই না। তুমিই বলো।”
আমি তখন মায়ী মায়ীর কিছু অত্যাচারের কথা বললাম এবং আমার কথা শুনে হলঘরের মানুষ কেমন শিউরে শিউরে উঠতে লাগল। আমার কথা শেষ হবার পর সবাই নিঃশব্দে বসে রইল। বিজ্ঞানী লিংলি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ছেলে। তোমাদের দুঃখের এবং কষ্টের দিন শেষ হয়েছে। আমি তোমাদের মুক্ত করে এনেছি। এই শহরে তোমরা এখন মুক্ত মানুষের মতো থাকো। জীবন। উপভোগ করো।”
আমি নিচু গলায় বললাম, “করব। জীবন উপভোগ করব।”
বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “তোমরা দুজন এখন এখানে কী ধরনের জীবন চাও?”
আমি আর টিশা একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। এই প্রশ্নটির কী উত্তর দেওয়া যায়? সত্যি কথা বলতে হলে বলতে হবে যে, আমরা স্বাধীন একটা জীবন চাই। কিছুই করতে চাই না, কোনো গাছের ছায়ায় বসে ভিডি টিউবে বই পড়তে চাই। কিন্তু মনে হলো সেটা বলা ঠিক হবে না।
আমাদের চুপ করে থাকতে দেখে বিজ্ঞানী লিংলি নিজে থেকে বলল, “তোমরা কি আমার ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে চাও?”
আমরা কিছু বলার আগেই হলঘরের সব মানুষ আমাদের এত বড় সৌভাগ্যের কথা শুনে আনন্দে চিৎকার করে উঠল। বোঝাই যাচ্ছে, এই শহরের খুব সৌভাগ্যবান অল্প কিছু মানুষ লিংলির মতো এত বড় একজন বিজ্ঞানীর ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সুযোগ পায়।
কমান্ড্যান্ট এতক্ষণ কোনো কথা বলছিল না, এবারে আমাদের পিঠে হাত দিয়ে বলল, “অভিনন্দন রিহি এবং টিশা! এই শহরের খুব অল্প কিছু তরুণ-তরুণী বিজ্ঞানী লিংলির সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে।”
আমি আর টিশা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “আমার ল্যাবরেটরি কমপ্লেক্সে থাকার জন্য হোস্টেল আছে, ডরমিটরি আছে। আমি তোমাদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দেব।”
আমি বললাম, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মহামান্য লিংলি।”
টিশা কোনো কথা না বলে বিচিত্র এক ধরনের দৃষ্টিতে বিজ্ঞানী লিংলির দিকে তাকিয়ে রইল।
১২. পরদিন ভোর বেলা আমাকে
পরদিন ভোর বেলা আমাকে আর টিশাকে বিজ্ঞানী লিংলির ল্যাবরেটরি কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলো। অনেক উঁচু একটা বিল্ডিংয়ের লিফটে করে আমরা দুজন যখন উপরে উঠছিলাম তখন আমি ফিসফিস করে টিশাকে বললাম, “আমাদের কি এখন হোস্টেলে নিয়ে যাচ্ছে?”
টিশা কোনো কথা বলল না। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে টিশা হঠাৎ করে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। লিফটটি প্রায় বাইশ তলা ওঠার পর বন্ধ হয়ে গেল, তখন আমরা লিফট থেকে নামলাম। আমাদের সাথে যে মানুষটি ছিল সে আমাদেরকে বলল, “তোমাদের এখন সিঁড়ি দিয়ে বাকি দুই তলা উঠতে হবে। এর উপরের অংশে লিফট যায় না।”
আমি আর টিশা অবাক হলাম, এত উঁচু বিল্ডিংয়ের একেবারে উপরে পর্যন্ত লিফট যায় না সেটি কেমন ব্যাপার? কিন্তু আমাদের এ নিয়ে কথা বলার কিংবা তর্ক-বিতর্ক করার কোনো সুযোগ নেই, আমরা তার চেষ্টাও করলাম না। আমরা আমাদের ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলাম, যে মানুষটি আমাদের এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে সে আমাদের সাথে আর উপরে উঠল না।
আমাদের কয়েকটা চেকপোস্ট পার হতে হলো, কোথাও কোনো মানুষ নেই, চেকপোস্ট পার হওয়ার জন্য কী করতে হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার নির্দেশ দেওয়া হতে লাগল। আমরা সেই নির্দেশ মেনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। কোনো চেকপোস্টে রেটিনা স্ক্যান আমি বললাম,