মহিলাটি বিরক্ত হয়ে বলল, “এখন আমার সাথে কথা না বলে কমান্ড্যান্ট কী বলছে সেটা শোনো।”
কমান্ড্যান্ট বলল, “এই ক্রেনিপিউটার আমাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া সভ্যতাকে আবার নতুন করে দাঁড়া করাবে। একবিংশ শতাব্দীতে কম্পিউটার যে ভূমিকা রেখেছিল এই শতাব্দীতে ক্রেনিপিউটার সেই একই ভূমিকা রাখবে। পৃথিবীর সব প্রযুক্তি হয় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল না হয় ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল। এই সময়ে মহাবিজ্ঞানী লিংলি একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে দাঁড়া করিয়েছে এই নতুন যুগের ক্রেনিপিউটার।”
হলঘরের সব মানুষ রীতিমতো চিৎকার করে হাততালি দিতে থাকে। কমান্ডেন্ট হাততালি থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, “আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার এই মহাবিজ্ঞানী লিংলি আমাদের শহরের একজন মানুষ। আমাদের এই শহরে বসে গবেষণা করে সে এই ক্রেনিপিউটার গড়ে তুলেছে। সেই ক্রেনিপিউটার এখন এই শহরকে নিয়ন্ত্রণ করছে। নেটওয়ার্কের সাহায্যে সেটা ইতোমধ্যে আশেপাশের শহরের সাথে যোগাযোগ করছে। একসময় সেই শহরগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করবে। এভাবে ধীরে ধীরে একসময় নিশ্চয়ই সারা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করবে।”
এই শহরের একটা ক্রেনিপিউটার সারা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করবে শুনে হলঘরের মানুষেরা রীতিমত উত্তেজিত হয়ে হাততালি দিতে শুরু করে। কমান্ডেন্ট হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে আবার কথা বলতে শুরু করে, বাঁধাধরা কথা। এরকম কথা আমরা আমাদের শহরে আমাদের কমান্ড্যান্টের মুখে অনেকবার শুনেছি। কথা শুনতে শুনতে আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম।
কতক্ষণ কমান্ড্যান্ট কথা বলেছে আমি জানি না। হঠাৎ করে হলঘরের সব মানুষ একেবারে পাগলের মতো চিৎকার করে হাততালি দিতে দিতে দাঁড়িয়ে গেল। কমান্ড্যান্টের ঠিক কোন কথাটি শুনে হলঘরের সব মানুষ এ রকম উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে আমি লক্ষ করিনি। নিচু হয়ে টিশাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে টিশা? কমান্ডেন্ট কী বলেছে?”
“বলেছে, বিজ্ঞানী লিংলি এখন এখানে আসবে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। সত্যি।”
এবারে আমিও একটু উত্তেজিত হয়ে গেলাম। এতবার বিজ্ঞানী লিংলির এত কথা শুনেছি, তাই মানুষটাকে আমার দেখার খুব আগ্রহ ছিল। আমিও এবারে হাততালি দিতে দিতে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কমান্ড্যান্ট স্টেজের এক পাশে এগিয়ে গেল এবং আমি দেখলাম সে একজন কমবয়সী মানুষকে স্টেজের মাঝখানে নিয়ে এল। খুবই সাদামাটা ধরনের মানুষ, সাদামাটা পোশাক পরে আছে। গায়ের রং রোদে পোড়া, চুলগুলো বেশ লম্বা কাঁধ পর্যন্ত নেমে আছে, চোখগুলো জ্বলজ্বলে।
কমান্ড্যান্ট বলল, “মহাবিজ্ঞানী লিংলি, তুমি আমাদের আমন্ত্রণ রক্ষা করে আজকে কমিউনের এই মিটিংয়ের এসেছ সে জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”
বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। আমি আমার শহরের মানুষদের সাথে কথা বলতেই পারি, এটা এমন কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা নয়।”
কমান্ড্যান্ট বলল, “তোমার কাছে এটা ঐতিহাসিক ঘটনা নাও হতে পারে কিন্তু আমাদের জন্য এটি অনেক বড় একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। যাই হোক, মহামান্য বিজ্ঞানী লিংলি, তোমার আবিষ্কার করা ক্রেনিপিউটার আজ থেকে এই পুরো শহরকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেটা দেখে তোমার কেমন লাগছে?”
বিজ্ঞানী লিংলি হাসি হাসি মুখে বলল, “নিয়ন্ত্রণ করছে বলা হলে সেটা একটু অন্যরকম শোনায়, আমার মনে হয় বলা উচিত শহরের সকল দৈনন্দিন কাজে সহায়তা করছে।”
কমান্ড্যান্টের মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হলো, সে বলল, “তোমার জ্ঞান, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা এবং দূরদৃষ্টির উপর এই শহরের সকল মানুষের অনেক বেশি বিশ্বাস। তুমি যদি তোমার আবিষ্কৃত ক্রেনিপিউটার দিয়ে এই শহরকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণও কর, সবাই সেটা খুব আনন্দের সাথে গ্রহণ করবে।”
হলঘরের সব মানুষ আনন্দের শব্দ করে কমান্ড্যান্টের কথার প্রতি সমর্থন জানাল। বিজ্ঞানী লিংলি তার মাথার এলোমেলো লম্বা চুলকে পেছনে সরিয়ে বলল, “শুনে খুশি হলাম। তবে আমি সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, একটা শহর দূরে থাকুক আমি একটা মানুষকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না। প্রত্যেকটা মানুষ আসলে এই পৃথিবীর একটা সম্পদ, কারণ প্রত্যেকে একটা মস্তিষ্ক নিয়ে জন্মেছে। সেই মস্তিষ্কের একশ বিলিয়ন নিউরন নিয়ে সে এই পৃথিবীর একটি অনেক বড় সম্ভাবনা। ক্রেনিয়াল দিয়ে সেখানে আমরা নতুন তথ্য দিয়ে নতুন জ্ঞান প্রবেশ করিয়ে তাকে আরো বিকশিত হতে দিতে চাই, কিন্তু কোনোভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না, কোনোভাবে তার স্বাধীন সত্তাকে নষ্ট হতে দিতে চাই না।”
কমান্ড্যান্টের একটা সাধারণ কথা শুনেই হলঘরের মানুষেরা হাততালি দিচ্ছিল, লিংলির মতো এত বড় একজন বিজ্ঞানীর কথা শুনে দর্শকেরা মনে হয় একেবারে অভিভূত হয়ে গেল। তারা সবাই দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে থাকে।
বিজ্ঞানী লিংলি হাসি হাসি মুখে স্টেজে দাঁড়িয়ে সবাইকে এক নজর দেখে বলল, “সত্যি কথা বলতে কী একজন মানুষের স্বাধীনতা আমার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ যে, কয়েক দিন আগে আমি জানতে পেরেছিলাম একটি অসভ্য বর্বর বন্য দস্যুদল দুজন কিশোর কিশোরীকে বন্দি করে রেখেছে। আমি সেই দস্যুদলের সাথে যোগাযোগ করে দস্যুদলকে প্রয়োজনীয় মুক্তিপণ দিয়ে সেই দুজন কিশোর-কিশোরীকে মুক্ত করিয়ে এনেছি।”