খুঁজে খুঁজে শহরের শেষ প্রান্তে আমরা লাইব্রেরিটা আবিষ্কার করলাম, বেশ বড় আলোঝলমল একটা দালান। ভেতরে লোকজন যাচ্ছে এবং বের হচ্ছে, আমরা দুজনও ভেতরে ঢুকে গেলাম। গেটে আইডি কার্ডটা স্পর্শ করতেই একটা কর্কশ শব্দ হলো এবং কোথা থেকে জানি একজন বয়স্ক মানুষ বের হয়ে এল। আমাদের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী চাও?”
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, “লাইব্রেরিতে যাব।”
মানুষটি শব্দ করে হেসে উঠল, বলল, “তোমরা লাইব্রেরিতে গিয়ে কী করবে? তোমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল কোথায়?”
টিশা বলল, “ক্রেনিয়াল না থাকলে লাইব্রেরি যাওয়া যায় না?”
“না।”
“ও!” টিশা বলল, “আমরা ভেবেছিলাম ভিডি টিউবে ক্রিস্টাল দিয়ে বই পড়া যায়।”
টিশার কথা শুনে মানুষটি আবার হাসতে থাকে, মনে হলো রীতিমতো কষ্ট করে হাসি থামিয়ে বলল, “ভিডি টিউব আর ক্রিস্টাল দেখতে হলে তোমাদের মিউজিয়ামে যেতে হবে! তোমরা কারা? মনে হয় অন্য জগৎ থেকে এসেছ!”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “ঠিকই বলেছ! আমরা মোটামুটি অন্য জগৎ থেকে এসেছি।”
আমরা বের হয়ে আসার আগে ভেতরে একবার উঁকি দিলাম। ছোট ছোট অসংখ্য খুপরি। প্রত্যেকটা খুপরিতে একটা করে মানুষ। দেয়াল থেকে একটা তার এসে তাদের ক্রেনিয়ালে ঢুকে গেছে। দস্যুদলে আমরা যে রকম ক্রেনিয়াল টিউব দেখেছিলাম এটা সে রকম নয়। কোনো এক ধরনের ক্যাবল দিয়ে সরাসরি ক্রেনিয়ালে তথ্য ঢোকানো হচ্ছে। মানুষগুলো চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে বসে আছে।
আমরা সন্ধে হওয়ার অনেক আগেই আমাদের হোস্টেলে অপেক্ষা করতে থাকি। ভেতরে এক ধরনের চাপা দুশ্চিন্তা কাজ করছিল, বিজ্ঞানী লিংলি কী মূল্য দিয়ে মায়ী মায়ীর কাছ থেকে আমাদের কিনেছে আমরা জানি না, কেন কিনেছে তাও জানি না। ভাসাভাসা ভাবে মায়ী মায়ীর কাছে যেটা শুনেছিলাম সেটাও ভালো কিছু নয়–তবে তার কথা কতটুকু বিশ্বাস করা যায় কে জানে।
সন্ধের একটু আগে একজন মানুষ এসে আমাদের দুজনকে হোস্টেল থেকে বাইরে এনে একটা গাড়িতে বসাল। গাড়ির ভেতরে আবছা অন্ধকার, চোখটা একটু সয়ে এলে দেখলাম, সেখানে সেজেগুঁজে থাকা একজন মহিলা আগে থেকে বসে আছে। আমাদের দিকে তাকিয়ে একধরনের মাপা হাসি দিয়ে বলল, “তোমরা রিহি এবং টিশা?”
আমরা দুজন মাথা নাড়ালাম।
“দুর্ধর্ষ দস্যুদল মায়ী মায়ীর হাতে বন্দি ছিলে?”
আমরা আবার মাথা নাড়লাম।
“বন্দি জীবন থেকে মুক্ত হয়েছ সে জন্য অভিনন্দন।”
আমরা নিচু গলায় বললাম, “ধন্যবাদ।”
মহিলাটি তখন চুপ করে গেল এবং জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?”
“কমিউনের মিটিংয়ে।”
আমরা দুজনেই খুব অবাক হলাম। আমি আর টিশা কেউই এই শহরের মানুষ নই। এই শহরের কমিউনিটি মিটিংয়ে আমাদের দুজনের কারোরই কোনো কিছু জানার নেই, কোনো কিছু বলারও নেই। তাহলে আমাদের সেখানে কেন নেয়া হচ্ছে?
গাড়িটি আমাদের শহরের মাঝামাঝি নিয়ে গেল, সেখানে একটা বিশাল হলঘরে আমাদের দুজনকে নিয়ে মহিলাটি ঢুকে গেল। মিটিং শুরু হতে এখনো দেরি আছে, চেয়ারগুলো বেশির ভাগই ফাঁকা। মহিলাটি আমাদের দুজনকে নিয়ে মাঝামাঝি এক জায়গায় বসিয়ে নিচু গলায় বলল, “তোমরা দুজন নিজে থেকে কারো সাথে একটি কথা বলবে না। ঠিক আছে?”
আমি আর টিশা মাথা নাড়লাম, নিজে থেকে কোনো কথা বলা যাবে না কিন্তু অন্যেরা চাইলে কি কথা বলা যাবে? আমরা অবশ্য ব্যাপারটার আর কোনো ব্যাখ্যা চাইলাম না।
ধীরে ধীরে হলঘরটা ভর্তি হতে লাগল। যারা আসছে তাদের বেশির ভাগই একটু বয়স্ক মানুষ, আমার আর টিশার বয়সী মানুষ খুব কম। পুরুষ এবং মহিলার সংখ্যা প্রায় সমান সমান। সামনে স্টেজে একজন মানুষ সবাইকে ব্যস্ত রাখার জন্য একটা পিয়ানো বাজাতে লাগল, খুবই একঘেয়ে সুর কিন্তু প্রত্যেকটার একটা অংশ শেষ করার সাথে সাথে সবাই এমনভাবে উচ্ছাস প্রকাশ করতে লাগল যে আমার সন্দেহ হতে লাগল ক্রেনিয়ালে করে এদের মাথায় এই পিয়ানো সংগীতের জন্য আলাদাভাবে ভালোবাসা তৈরি করে রাখা আছে।
একসময় পিয়ানো বন্ধ হয়ে গেল এবং মঞ্চে এই শহরের কমান্ড্যান্ট এসে ঢুকল। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হাততালি দিতে থাকে। কমান্ড্যান্ট মানুষটি মাঝবয়সী এবং দেখতে প্রায় আমাদের শহরের কমান্ড্যান্টের মতো, মানুষটি যখন মাইক্রোফোনে কথা বলতে থাকে, তখন আবিষ্কার করলাম তার কথা বলার ধরনটুকুও হুবহু আমাদের শহরের কমান্ড্যান্টের মতো। কমান্ড্যান্ট বলতে শুরু করল, “আমার প্রিয় শহরবাসী, কমিউনের সভায় তোমাদের আমন্ত্রণ।”
কমান্ড্যান্ট একটু থামল এবং সবাই জোরে জোরে হাততালি দিতে লাগল। আমাদের কমান্ড্যান্টের মতো এই কমান্ড্যান্টের কথার মাঝখানেও একটু পরে পরে হাততালি দিতে হয়।
কমান্ড্যান্ট বলল, “আজকে আমাদের খুব আনন্দের দিন। আজকে প্রথমবার আমাদের প্রিয় শহরের নিয়ন্ত্রণের পুরোটুকু করা হচ্ছে আমাদের নিজস্ব যান্ত্রিক ক্রেনিপিউটারে।”
সব মানুষ এবারে আরো জোরে হাততালি দিতে শুরু করে। আমি পাশে বসা সেজেগুঁজে থাকা মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ক্রেনিপিউটারটা কোথায়?”
মহিলাটি বলল, “বিজ্ঞানী লিংলির ল্যাবরেটরিতে।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কী দেখতে যাওয়া যাবে?”