আমি আর টিশা খুব সাবধানে কাজ করতে শুরু করলাম, কিন্তু কোনো কিছু করার আগেই হঠাৎ করে একদিন আবিষ্কার করলাম মায়ী মায়ী আমাদের দুজনকে বিজ্ঞানী লিংলির কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।
মায়ী মায়ীর ট্রেইলারের বাক্স থেকে এগারটা ক্রেনি-টিউব সরিয়ে নেওয়া ছাড়া আমরা আর কিছুই করতে পারলাম না।
১১. বিজ্ঞানী লিংলির শহরে এসে
তৃতীয়পর্ব
১১.
বিজ্ঞানী লিংলির শহরে এসে অনেক দিন পর আমি আর টিশা আবার স্বাধীন মানুষ হয়ে থাকার আনন্দটা উপভোগ করতে লাগলাম। গলা থেকে শিকল ঝুলছে না, কেউ সেই শিকল ধরে রাখছে না, কিছু একটা উনিশ-বিশ হতেই কেউ কুৎসিত একটা গালি দিয়ে পেছন থেকে একটা দড়ি দিয়ে মারছে না। তার চাইতে বড় কথা দস্যুদলের মাঝে যে সারাক্ষণ একটা অপমান সহ্য করতে হয়েছে সেই অপমানটুকু নেই, অন্য সবার মতো মানুষের একটা সম্মান নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারছি, বিষয়টি বিশ্বাস করতেই আমাদের প্রথম প্রথম কষ্ট হতো।
আমাদেরকে একটা বড় হোস্টেলে রাখা হয়েছে। নিজেদের জন্য আলাদা ছোট ছোট ঘর, নিচে খাবার জায়গা। পুরো হোস্টেলে অনেকে থাকে, কে কী করে, কেন এখানে থাকে সেটি পরিষ্কার নয়। আমাদের দুজনকে বলে দেওয়া হয়েছে আমরা যেন নিজেদের সম্পর্কে একটা কথাও না বলি–সে রকম অন্য সবাইকেই নিশ্চয়ই একই কথা বলা হয়েছে, তাই কেউ কারো সাথে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলে না। প্রতিদিন ভোরে নিজেদের ব্যবহারের জন্য আমাদের জন্য তৈরি করা আইডি কার্ডে কিছু ইউনিট ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আমরা যখন শহরে ঘুরে বেড়াই তখন নিজেদের ছোটখাটো প্রয়োজনে ইউনিটগুলো খরচ করতে পারি। আমাদের আইডি কার্ডগুলো নিরীহ আইডি কার্ড নয়, এটি প্রতি মুহূর্তে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও আমাদের সম্পর্কে তথ্য পাঠাতে থাকে, আমরা মুক্ত মানুষের মতো সারা শহরে ঘুরে বেড়ালেও সারাক্ষণ যে আমাদের উপর নজর রাখা হচ্ছে আমরা সেটি টের পাই। এটাও এক ধরনের শেকল, মায়ী মায়ীর শেকলের মতো অশালীন শেকল নয়, খুব সূক্ষ্ম এক ধরনের অদৃশ্য শেকল।
বিজ্ঞানী লিংলির শহরটি খুব সুন্দর। আমাদের শহরের মতো খাপছাড়া নয়, আমাদের শহরের মতো ছোট নয়, এটা অনেক বড়। আমরা ইচ্ছে করলেই আমাদের পুরো শহরটা একদিনে ঘুরে আসতে পারতাম, এই শহরটার এক মাথা থেকে অন্য মাথা দিনে দিনে ঘুরে আসা সম্ভব নয়। শহরের মাঝখান দিয়ে ট্রাম লাইন আছে, জায়গায় জায়গায় পার্ক, পার্কে ফুলের বাগান এবং বসার জায়গা। শহরের এক পাশ দিয়ে অপূর্ব একটা খাল, খালের দুই পাশে ছায়াঢাকা বড় বড় গাছ, সেখানে বসার জন্য একটু পরপর কাঠের বেঞ্চ। বিকেল বেলা তরুণ-তরুণীরা রঙিন পোশাক পরে সেখানে ভিড় করে আসে।
দিনের বেলা মানুষজন শহরে ঘুরে বেড়ায়। যারা বয়স্ক তাদের সবার মাথার মাঝে ক্রেনিয়াল, তাদের চোখে-মুখে এক ধরনের প্রশান্তির চিহ্ন। তাদের চলাফেরায় কোনো ব্যস্ততা নেই। কমবয়সী তরুণ-তরুণীরা যাদের মাথায় এখনো ক্রেনিয়াল লাগানো হয়নি তাদের চেহারায় মাঝে মাঝে অস্থিরতার ছাপ দেখা যায়। মাঝে মাঝেই দেখা যায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অকারণে হি হি করে হাসছে। কিংবা উচ্চ স্বরে কোনো কিছু নিয়ে তর্ক করছে। শক্ত সমর্থ দুজন তরুণকে একদিন ঘুষোঘুষিও করতে দেখেছি। মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানোর পর সবাই শান্ত হয়ে যাবে, সবাই সভ্য ভব্য কাজের মানুষ হয়ে যাবে।
আমি আর টিশা শহরটি ঘুরে ঘুরে দেখতে গিয়ে একদিন লিংলির ল্যাবরেটরিটা আবিষ্কার করে ফেলোম। শহরের এক পাশে বিরাট এলাকা নিয়ে ল্যাবরেটরি কমপ্লেক্স, উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা হলেও বড় বিল্ডিংগুলো বাইরে থেকে দেখা যায়। প্রতিদিন ভোরে দলে দলে মানুষ সাদা অ্যাপ্রোন পরে ল্যাবরেটরিতে ঢোকে–দুপুর বেলা একদল বের হয়ে অন্য এক দল ঢোকে, বিকেলেও একই অবস্থা। ল্যাবরেটরি কখনো বিশ্রাম নেয় না–গভীর রাতেও সেখানে অনেক মানুষ থাকে।
ল্যাবরেটরির কমপ্লেক্সের একটি মাত্র গেট, সেই গেট দিয়ে সব মানুষকে ঢুকতে হয় আবার বের হতে হয়। তাদের গলায় ঝোলানো ব্যাজ থাকে, চোখের রেটিনা স্ক্যান করে ব্যাজের সাথে মিলিয়ে সবাইকে ভেতরে ঢোকানো হয়। সবকিছু স্বয়ংক্রিয়, কোনো মানুষের প্রয়োজন নেই, তারপরও কয়েকজন বড় মানুষ হাতে ভয়ংকর অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে তীক্ষ্ণ চোখে পরীক্ষা করে। আমরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিষয়টা দেখছিলাম, তখন পাহাড়ের মতো একজন আমাদের ধমক দিয়ে বলল, “এখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছ? ভাগো এখান থেকে।”
আমি আর টিশা সাথে সাথে সরে এসেছি।
.
সপ্তাহ দুয়েক পর ভোরবেলা নাশতা করে আমি আর টিশা যখন হোস্টেল থেকে বের হচ্ছি, তখন হোস্টেলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি আমাদের থামাল, বলল, “কোথায় যাও?
এর আগে আমাদের কখনো কেউ থামায়নি। তাই আমরা একটু অবাক হলাম, ইতস্তত করে বললাম, “এই তো, বাইরে, একটু শহরটা ঘুরে দেখছি।”
“যেখানেই যাও সন্ধের আগে ফিরে আসবে।”
আমরা মাথা নাড়লাম, বললাম, “ফিরে আসব।”
টিশা জিজ্ঞেস করল, “কেন? আজকে কী হবে?”
“আমি জানি না। কিন্তু তোমাদের ফিরে আসতে হবে। আইডি কার্ডে সব দেখতে পাবে।”
.
আজকে আমাদের শহরের লাইব্রেরিটি খুঁজে বের করার কথা। বেশ আগ্রহ নিয়ে দুজনেই সেটা খুঁজে বের করার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মহিলাটির কথা শুনে আমাদের উৎসাহে একটু টান পড়ল, তারপরেও দুজনে বের হয়ে গেলাম।