আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, “না না টিশা, কেন বলতে পারবে না। অবশ্যই বলতে পারবে। কিন্তু
“কিন্তু কী?”
“কিন্তু এই কথাগুলো কেমন করে তোমার মাথায় এল? এগুলো তো খুব ভয়ের কথা।”
“কথাগুলো যদি আমার মাথার ভেতরে থাকে তাহলে কেউ জানবে না। যদি তুমি বলে না দাও! আমি জানি তুমি কখনো বলবে না–তাই কেউ জানতে পারবে না যে আমার মাথার মাঝে ভয়ের কথা ঘুর ঘুর করতে থাকে। যে আমার মাথার মাঝে কী কথা ঘুর ঘুর করে তাতে কিছু আসে যায় না রিহি! কিছু আসে যায় না।”
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “একটা জিনিস জান টিশা?”
“কী?”
“একজন মানুষের মনের মাঝে কী কথা আছে সেটা কীভাবে কীভাবে জানি বের হয়ে যায়। তাই আমার খুব ভয় করে। তোমার
মনের কথা যদি কমিউনের মানুষেরা টের পেয়ে যায় তাহলে তোমার খুব বিপদ হয়ে যাবে।”
টিশা হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে শুরু করে, তার সেই বিচিত্র হাসি যেটা শুনে আমার মনে হয় এই টিশাকে আমি চিনি না, তাকে আগে কখনো দেখিনি।
আমি বললাম, “তুমি হাসছ কেন?”
“এমনি। আমি তো বোকা একটা মেয়ে তাই মাঝে মাঝে হঠাৎ বোকার মতো হেসে ফেলি।”
আমি বললাম, “টিশা তুমি মোটেও বোকা একটা মেয়ে না। তাই আমার খুব ভয় হয়। তুমি বোকা হলে তোমাকে নিয়ে আমি একটুও ভয় পেতাম না।”
টিশা তার হাসি থামিয়ে দূরে তাকাল, সূর্যটা নিচে নেমে আসছে। আকাশে লালচে ধুলো, তার ভেতর দিয়ে সূর্যটাকে কেমন জানি বিবর্ণ দেখাচ্ছে। টিশা কিছুক্ষণ সূর্যের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “চলো যাই।”
বলে সে আমার জন্য অপেক্ষা না করে একটা কংক্রিটের টুকরো থেকে আরেকটা কংক্রিটের টুকরোর উপর লাফিয়ে ছুটতে শুরু করে। আমি বললাম, “দাঁড়াও টিশা! এত জোরে ছুটে যেয়ো না, আমি তোমার মতো এখানে এত জোরে ছুটতে পারি না।”
টিশা আমার কথা শুনল না, লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটতেই লাগল। আমি আর কী করব, আমিও তার পিছু পিছু ছুটতে লাগলাম। টিশার কাছাকাছি পৌঁছে বললাম, “টিশা! তোমাকে একটা কথা বলি?”
“কী কথা?”
“এই যে তুমি আমাকে এত সব কথা বলেছ সেগুলো মাথা থেকে বের করে দিতে পারবে?”
টিশা মাথা ঘুরিয়ে সূর্যটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঐ সূর্যটাকে তোমার কী মনে হয়?”
সে আমার কথাটা না শোনার ভান করছে। আমি আবার বললাম, “টিশা! আমার কথা একটু শোনো। তোমার মাথার ভেতর থেকে ঐ চিন্তাগুলো দূর করে দাও।”
টিশা বলল, “ঐ সূর্যটাকে দেখলে মনে হয় ওটা সুস্থ নয়, ওটার পচন ধরেছে।”
আমি বললাম, “তুমি আমার কথা না শোনার ভান করছ কেন টিশা?”
টিশা বলল, “এই কংক্রিটের টুকরোগুলো কী কুৎসিত, তাই না রিহি? সুন্দর একটা প্রাচীর তৈরি না করে এক গাদা কংক্রিটের টুকরো ফেলে দিয়ে একটা প্রাচীর কেন তৈরি করল?”
আমি বুঝলাম টিশা আমার কথার উত্তর দেবে না, তাই আমি চুপ করে গেলাম।
সূর্যটা ডুবে যাবার পর আমি আর টিশা প্রাচীর থেকে নেমে আসি। ভাঙা ধসে যাওয়া দালান, ইট পাথর কংক্রিটের জঞ্জাল, জং ধরা ভাঙা যন্ত্রপাতি পার হয়ে আমরা শহরের ভেতর ঢুকি। শহরের পথে মাঝে মাঝে টিম টিম করে আলো জ্বলছে, আধো আলো আধো অন্ধকারে মানুষজন নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে। জনমানবহীন উঁচু দালানের কোথাও কোথাও আলো জ্বলছে। দূরে ঘর ঘর শব্দ করে একটা জেনারেটর চলছে। এই শব্দটুকু না থাকলে পুরো শহরটাকে একটা ভুতুড়ে শহর বলে মনে হতো। কী মন খারাপ করা একটা পরিবেশ, আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলোম।
ঠিক তখন আমরা পথের পাশে একটা মানুষের মূর্তিকে দেখতে পেলাম। হাতে একটা মপ নিয়ে সে রাস্তা পরিষ্কার করছে, তার মাঝে কোনো ব্যস্ততা নেই। মাটির দিকে তাকিয়ে সে মপ দিয়ে ঘষে ঘষে সব আবর্জনা দূর করছে। আমরা দেখলাম মানুষটার পাশে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে তাকে কিছু একটা বলছে। আরেকটু কাছে যাবার পর আমরা মহিলার কথা শুনতে পেলাম, নিচু স্বরে বলছে, “বাবা কুনিল, একবার আমার দিকে তাকা। একবার আমার কথা শোন।”
আবছা অন্ধকারে আমরা এতক্ষণ চেহারা দেখতে পাইনি। এবারে তাকে চিনতে পারলাম, মানুষটি কুনিল। কুনিলের পাশে তার মা তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। একজন মানুষকে ডিটিউন করে ফেললে তার মস্তিষ্ককে মোটামুটিভাবে অচল করে দেওয়া হয়। তখন সে কাউকে চিনতে পারে না, নিজের মাকেও চিনতে পারে না।
কুনিলের মা কাতর গলায় বলল, “বাবা কুনিল। কুনিল সোনা আমার।”
কুনিল খুব ধীরে ধীরে তার মাথা ঘুরিয়ে তার মায়ের দিকে তাকাল, আবছা অন্ধকারে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু জানি কুনিলের শূন্য দৃষ্টিতে জীবনের কোনো চিহ্ন নেই।
কুনিলের মা বলল, “বাবা কুনিল। কুনিল। কুনিল সোনা। একবার একটা কথা বল। মাত্র একবার!”
আমরা পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় শুনতে পেলাম কুনিল মুখ দিয়ে অস্পষ্ট এক ধরনের শব্দ করছে। সেই শব্দের কোনো অর্থ নেই। একটি অবোধ পশু আর কুনিলের মাঝে এখন কোনো পার্থক্য নেই। কুনিলের মা সেটা এখনো মেনে নিতে পারেনি।
০২. লম্বা হলঘরটাতে আমরা
লম্বা হলঘরটাতে আমরা সারি বেঁধে বসে আছি। আজকে এই শহরের কমিউনের সভা, তাই শহরের মানুষেরা এসেছে। শহরের সব মানুষকে নিয়ে একসাথে সভা করা যায় না। তাই একেক দিন একেক ধরনের মানুষকে নিয়ে সভা করা হয়। আজকের সভাটা আমাদের মতো কমবয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে। সবাই এসেছে কিনা বুঝতে পারছি না–আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে পরিচিত সবাইকে পেয়ে গেছি। শুধু টিশাকে এখনো দেখছি না। আমি পাশের জায়গাটা খালি রেখেছি টিশার জন্যে–টিশা এতই খেয়ালি মেয়ে সে হয়তো আমার পাশে বসতেই চাইবে না।