আমি ভেতর থেকে একটা ক্রেনি-টিউব বের করে বাক্সটা আবার বন্ধ করে দিলাম। টিউবটা নিজের কাছে না রেখে ট্রেইলারের এক কোনায় ফেলে রেখে দিলাম। মায়ী মায়ী যদি তার বাক্স খুলে বুঝতে পারে একটা টিউব নেই এবং সেটা নিয়ে হইচই করে তখন খোঁজার ভান করে ট্রেইলারের কোনা থেকে এটা বের করে দেওয়া যাবে। মায়ী মায়ী মনে করবে টিউবগুলো নাড়াচাড়া করার সময় তার অজান্তে একটা নিচে পড়ে গেছে।
পরের কয়েক দিন আমরা খুব ভয়ে ভয়ে থাকলাম। মায়ী মায়ী বাক্স খুলে কয়েকবার ক্রেনিয়াল টিউব বের করে ব্যবহার করল, সে বুঝতে পারল না যে আমরা একটা সরিয়ে রেখেছি। তখন একদিন আমরা পকেটে করে টিউবটা নিয়ে বের হয়ে গেলাম। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে গেছে তখন খাঁচার ভিতরে আমি আর টিশা মিলে ক্রেনি টিউবটা খুলে ভেতরে কী আছে সেটা দেখার চেষ্টা করলাম। এত ছোট একটা টিউব, কোনো রকম টুল ব্যবহার না করে একেবারে খালি হাতে সেটা খুলতে পারব মনে করিনি কিন্তু এটাকে নানাভাবে টানাটানি করতে করতে হঠাৎ টিউবটা খুলে এল। আমাদের কাছে যেটুকু আলো আছে সেটাতে দেখলাম ক্রেনি-টিউবটার মাঝখানে ছোট একটা আইসি, সেখান থেকে মাত্র তিনটা তার বের হয়ে ভেতরে কানেকশন দেওয়া হয়েছে। দুটো নিশ্চিতভাবে একটা নিউক্লিয়ার ব্যাটারিতে গিয়েছে, তৃতীয়টা ক্রেনিয়ালের মাথায়। ছোট একটা স্কু ড্রাইভার দিয়েই আইসিটাকে খুলে আলাদা করে ফেলা যাবে।
আমি টিশার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “টিশা।”
“বলো।”
“আমরা এখন ইচ্ছে করলে পুরো দস্যুদলকে লন্ডভন্ড করে দিতে পারব।”
টিশা ভুরু কুঁচকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে?”
“আমরা মায়ী মায়ীর বাক্স থেকে ক্রেনি-টিউবগুলো বের করে যদি ভেতরের আইসিগুলো খুলে ওলটপালট করে দিই তাহলে কী হবে বুঝতে পারছ?”
টিশার মুখটা হাঁ হয়ে গেল, বলল, “যখন মনে করবে সিস্টেম সতের লোড করছে তখন আসলে হয়তো কুকুরের সিস্টেম লোড হয়ে যাবে। তখন ঘেউ ঘেউ করে ছুটে বেড়াবে!”
দৃশ্যটা কল্পনা করে আমি খুক খুক করে হেসে ফেলোম। বললাম “হ্যাঁ, ওরা কিছু বুঝতেই পারবে না, দুর্ধর্ষ দস্যুদল হয়তো মিনি বিড়াল হয়ে যাবে। এটা করার জন্য দরকার শুধু ছোট একটা স্কু ড্রাইভার! না পেলেও ক্ষতি নেই। এক টুকরো ছোট ধাতব পিনকে ঘষে ঘষে বানিয়ে ফেলতে পারব!”
টিশা বলল, “শুধু একটা সমস্যা।”
“কী সমস্যা?”
“কোন ক্রেনি-টিউব কোন কাজ করে আমরা জানি না। আইসি ওলটপালট করার সময় যদি ভুলভাবে ওলটপালট হয়ে যায় তাহলে দস্যুদল হয়তো জল্লাদের দল হয়ে যাবে! রাক্ষস হয়ে যাবে।”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ, আমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল থাকলে আমরা নিজেরাই পরীক্ষা করে বের করে ফেলতে পারতাম!”
আমি ক্রেনি-টিউবটা হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম, উপরে কিছু অক্ষর এবং কিছু সংখ্যা লেখা কিন্তু সেই অক্ষর কিংবা সংখ্যার অর্থ কী আমরা জানি না।
টিশা ভুরু কুঁচকে চিন্তা করতে করতে বলল, “কিছু একটা বুদ্ধি বের করে ফেলব।”
.
আমরা অবশ্যি অনেক চিন্তা করেও কোনো বুদ্ধি বের করতে পারলাম না, তখন একদিন আমরা আবার খুব সাহসের একটা কাজ করে ফেলোম। শুধু সাহসের না, খুবই বিপজ্জনক একটা কাজ।
আমাকে আর টিশাকে দুপুরবেলা একটা বড় লরির এক্সেলের সাথে বেঁধে এক ড্রাম ঝাঁঝালো গন্ধের সলভেন্ট দিয়ে গেছে। আমরা হাতে গ্লভস পরে সেই সলভেন্ট দিয়ে ইঞ্জিন পরিষ্কার করছি। মাঝে মাঝে কঠোর চেহারার একটা দস্যু এসে দেখে যাচ্ছে আমরা ঠিকভাবে কাজ করে যাচ্ছি কি না।
হঠাৎ একটা নারী কণ্ঠের কথা শুনলাম, কেউ একজন বলল, “কাজ কেমন চলছে?”
আমরা মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি রিয়ানা নামের মেয়েটি, যে এখন আর রিয়ানা নয়, যার নাম এখন দ্রিমা তিন। শীতের রাতে টিশার গান শুনে যে আমাদের খাঁচার নিচে থমকে দাঁড়িয়েছিল।
আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, “কাজ খুব ভালো চলছে।”
টিশা বলল, “ইঞ্জিনটা প্রায় চকচকে করে ফেলেছি।”
রিয়ানা কিংবা দ্রিমা তিন বলল, “তোমাদের এখানে আনন্দের কিছু নেই।”
আমরা চুপ করে রইলাম কারণ কথাটি সত্যি।
রিয়ানা বলল, “যদি তোমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল থাকত তাহলে তোমাদের মাথায় বেসিক একটা ক্রেনি-টিউব দিয়ে একটু আনন্দ দেওয়া যেত।”
আমরা এবারও চুপ করে রইলাম, কারণ আমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল নেই, বাইরে থেকে আমাদের মাথায় আনন্দ দেবার কোনো উপায় নেই। এই দস্যুদল যখন কোনো কাজ করে না তখন তাদের ক্রেনিয়ালে আনন্দ পাবার নানা ধরনের টিউব লাগিয়ে সময় উপভোগ করে। মানুষগুলোকে দেখলে তখন কেমন জানি অস্বস্তি হয়। প্রচণ্ড আনন্দে তাদের চোখ বন্ধ হয়ে যায়, শরীর কাঁপতে থাকে, মুখ দিয়ে লোল ঝরতে থাকে–এই তীব্র আনন্দটি আমরা কোনো দিন অনুভব করতে পারব না। হয়তো কোনো মাদক খেয়ে এরকম আনন্দ পাওয়া সম্ভব।
রিয়ানা বলল, “তোমরা কাজ করো, আমি যাই।”
তখন হঠাৎ করে টিশা তাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের সবার কাছে কি আনন্দ পাবার ক্রেনি-টিউব থাকে?”
“বেসিক টিউবটি সবার আছে। যার সিস্টেম যত বেশি সে তত তীব্র আনন্দের ক্রেনি-টিউব ব্যবহার করতে পারে।”
টিশা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কি একটা ক্রেনি-টিউব দেখে বলতে পার এটা কিসের টিউব?”