আমাদের দীর্ঘ ভ্রমণ উপভোগ করতে শুরু করলাম। ছোট খাঁচা থেকে পা বের করে পা ঝুলিয়ে খাঁচার শিক ধরে বসে চারদিক দেখতে দেখতে যেতাম। নিচ থেকে যে জিনিসটাকে খুব কুশ্রী মনে হয়, উপর থেকে সেটাকেই কেন সুন্দর মনে হয় কে জানে।
এর মাঝে একদিন অন্য একটা দস্যুদলের সাথে যুদ্ধ হলো। দুই দলে প্রচণ্ড গোলাগুলি, সবাই গাড়ির আড়ালে থেকে যুদ্ধ করছে, শুধু আমি আর টিশা শূন্যের মাঝে একটা খাঁচায় ঝুলছি। ইচ্ছে করলেই আমাদের দুজনকে গুলি করে মেরে ফেলা দেয়া যায়। কিন্তু কোনো একটা কারণে কেউ আমাদের গুলি করল না। মনে হয় যারা গোলাগুলি করছে তাদের কাছে আমাদের দুজনকে এত অকিঞ্চিৎকর মনে হয়েছে যে আমাদেরকে লক্ষ করে একটা গুলি করাও হয়তো তাদের কাছে গুলির অপচয় বলে মনে করেছে!
মায়ী মায়ীর দস্যুদল কিছুক্ষণের মাঝেই অন্য দস্যুদলটিকে তাড়িয়ে দিল। একজন আহত হয়েছিল বলে দলের সাথে পালিয়ে যেতে পারেনি। তাকে ধরে এনে সবাই মিলে তাকে নানাভাবে পীড়ন করতে শুরু করল। মানুষটি সব রকম অত্যাচার সহ্য করে পাথরের
মতো মুখ করে বসে রইল। তখন কয়েকজন মিলে তাকে মাটিতে উপুড় করে শক্ত করে ধরে রাখল, মায়ী মায়ী এসে তার ক্রেনিয়ালে একটা টিউব ঢুকিয়ে দেয়। মানুষটা যন্ত্রণার একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার করে থর থর করে কাঁপতে থাকে। ধীরে ধীরে তার কাঁপুনি থেমে যায়, তখন সে উঠে বসে, মানুষের মতো নয়–হাত এবং পায়ে ভর দিয়ে পশুর মতো। মানুষটি কেমন যেন ভয়ে ভয়ে সবার দিকে তাকাল, তারপর আকাশের দিকে মুখ করে অবিকল একটা কুকুরের মতো করুণ স্বরে ডেকে উঠল। তার সেই কুকুরের ডাক শুনে দস্যুদলের সবাই উচ্চস্বরে হাসতে থাকে–এই বিষয়টা যে এত কৌতুকের ব্যাপার হতে পারে আমি আর টিশা একবারও বুঝতে পারিনি।
কুকুরে পাল্টে যাওয়া মানুষটা চারপায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে থাকে, তারপর তার পায়ের ক্ষতটা কুকুরের মতো চাটতে থাকে। একজন দস্যু এসে তার গলায় একটা শিকল পরিয়ে তাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের দুজনকে যে কুকুরের মতো মানুষটা খুঁজে বের করেছিল সে কোথা থেকে এসেছিল সেটা আমাদের কাছে এখন পরিষ্কার হয়ে যায়।
.
কিছুদিন কেটে যাবার পর কীভাবে কীভাবে জানি আমাকে আর টিশাকে দস্যুদল মোটামুটি গ্রহণ করে নিল। ঠিক কারণটা কী জানি না–মনে হয় আমাদের বয়স কম, পাহাড়ের মতো বড় বড় দস্যুদের ভেতর আমাদের দুজনকে প্রায় খেলনার মতো মনে হয়। কিংবা পোষা কুকুর বিড়ালের উপর যে রকম মায়া পড়ে যায় হয়তো সেরকম আমাদের ওপর একটু মায়া হয়েছে।
দস্যুদল আমাদের গ্রহণ করতে শুরু করেছে ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম যখন দেখলাম তারা আমাদের ছোটখাটো জিনিসপত্র শেখাতে শুরু করেছে। একজন মাঝবয়সী দস্যু একদিন আমাদের গুনতে শেখাল–যদিও আমরা দুজন শুধু সাধারণভাবে নয় প্রাইম সংখ্যা ব্যবহার করে গুনতে জানি কিন্তু আমরা সেটা তাকে জানতে দিলাম না এবং খুব আগ্রহ নিয়ে শেখার ভান করলাম। দস্যুটি আমাদের শেখার আগ্রহ দেখে খুশি হলো এবং আমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানো হয়নি বলে খুব আফসোস করল। আরেক দিন একজন দস্যু আমাদেরকে সৌরজগতের গঠন ব্যাখ্যা করল, বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদের সংখ্যা বলতে গিয়ে সে একটু ভুল করে ফেললেও আমরা সেটা তাকে ধরিয়ে দিলাম না এবং পুরো ব্যাপারটা আগ্রহ নিয়ে শোনার ভান করলাম।
শুধু যে সাধারণ দস্যুরা আমাদের গ্রহণ করল তা নয়, মনে হলো খুব ধীরে ধীর মায়ী মায়ীও আমাদেরকে খানিকটা গ্রহণ করল। আগে কখনোই আমাদের দুজনকে একা তার ট্রেইলারে রেখে যেত না, কিন্তু এখন সে মাঝে মাঝে আমাদের গলায় শেকল দিয়ে টেবিলের সাথে বেঁধে রেখে বাইরে যেতে শুরু করল। তখন একদিন আমরা একটা ভয়ংকর সাহসের কাজ করে ফেলোম।
মায়ী মায়ীর ট্রেইলারে দেয়ালে একটা ছোট বাক্সে সে ক্রেনিয়ালে ঢোকানোর টিউবগুলো রাখে। যখন দরকার হয় সে বাক্সটা খুলে সেখান থেকে এই ক্রেনি-টিউবগুলো বের করে। বাক্সটা খোলার জন্য তার চোখের রেটিনা স্ক্যান করাতে হয়। মাঝে মাঝে যখন স্ক্যানারটা প্রথমবারে কাজ করে না তখন সে আলসেমি করে চোখের রেটিনা স্ক্যান না করিয়ে সরাসরি পাসওয়ার্ড ঢুকিয়ে বাক্সটা খুলে ফেলে। যখন সে পাসওয়ার্ডটি ঢোকায় তখন আমি আর টিশা না দেখার কিংবা না বোঝার ভান করে তার আঙুলের ওঠানামা দেখে পাসওয়ার্ডটি অনুমান করার চেষ্টা করেছি। রেটিনা স্ক্যান করাটি যেন ঠিক করে কাজ না করে আর তাকে যেন বারবার সরাসরি পাসওয়ার্ডটিই ঢোকাতে হয় সে জন্যে আমরা মাঝে মাঝেই রেটিনা স্ক্যানারটি একটু ময়লা করে রাখি। বেশ কয়েকবার মায়ী মায়ীর পাসওয়ার্ড ঢোকানো দেখে আমরা শেষ পর্যন্ত পাসওয়ার্ডটি জেনে গেছি।
একদিন যখন মায়ী মায়ী আমাদের দুজনকে তার টেবিলের সাথে বেঁধে রেখে বাইরে গেল তখন আমি আর টিশা মিলে তার ক্রেনিয়াল টিউবের বাক্সে পাসওয়ার্ড ঢুকিয়ে বাক্সটা খুলে ফেলোম। টিশা
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল, আর আমি দ্রুত ক্রেনিয়াল টিউবের বাক্সটার ভেতরে দেখে নিলাম। ক্রেনি-টিউবগুলো সারি সারি সাজানো আছে, যেদিকটা ক্রেনিয়ালে ঢোকাতে হয় সেদিকে ইলেকট্রিক সংযোগের জন্য ছোট ইন্টারফেস, উল্টো পাশে আলো জ্বলার জন্য ছোট ছোট রঙিন লেজার মডিউল। ছোট টিউবগুলোর উপর ছোট ছোট সংখ্যায় ক্রেনিয়ালের কোড লেখা।