সিস্টেম পনের লোড করা তিনজন মাথা নাড়ল, বলল, “পারে। মায়ী মায়ী পারে।”
মায়ী মায়ী বলল, “আমি তোদের ডেকেছি একটা পরমার্শ করার জন্য।” মায়ী মায়ী তখন আঙুল দিয়ে আমাদের দুজনকে দেখিয়ে বলল, “এই দুইটার মাথায় কেরেনিয়াল নাই–তার মানে এরা কিছু জানে না কিছু বুঝে না! এদের বয়স যতই হোক বুদ্ধিশুদ্ধি চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা থেকে বেশি হবে না। হবে?”
মানুষ তিনজন মাথা নাড়ল, পুরুষটা বলল, “যদি ক্রেনিয়াল না লাগায় তাহলে কেমন করে বুদ্ধিশুদ্ধি লোড করবে?”
মায়ী মায়ী বলল, “এখন এই দুইটাকে কী করি। এদের আমার দলে থাকা মানেই তো যন্ত্রণা? আমি কী ভাবছিলাম জানিস?”
“কী মায়ী মায়ী?”
“এদের বয়স তো কম–এদের কেটে হৃৎপিণ্ড ফুসফুস কলিজা কিডনি বের করে নিই। আমার শরীরে আরেকটা হৃৎপিণ্ড থাকলে ভালো না?”
আমার বুকটা ধক করে ওঠে! কী সর্বনাশ! মায়ী মায়ীর পরামর্শটা মানুষগুলোর খুব পছন্দ হলো, তারা জোরে জোরে মাথা নাড়তে থাকে। পুরুষ মানুষটা বলল, “খুবই ভালো বুদ্ধি মায়ী মায়ী।”
মহিলাটা বলল, “একটা সমস্যা কিন্তু আছে।”
মায়ী মায়ী ধমক দিয়ে বলল, “কী সমস্যা?”
“অপারেশনের পরে তোমাকে কমপক্ষে দুইদিন শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। তখন যদি সিস্টেম ষোল তোমাকে কিছু করে?”
মায়ী মায়ী চিৎকার করে বলল, “কী বললি তুই? সিস্টেম ষোল আমার সাথে বেঈমানি করবে? এত বড় সাহস?”
অন্য দুজন জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না না, করবে –কিন্তু কিছু বলা যায় না। তা ছাড়া এখন কি তোমার টানা দুইদিন বিশ্রাম নেবার সময় আছে?”
মায়ী মায়ী কী একটা চিন্তা করে মাথা নেড়ে বলল, “নাই।”
তার শরীরে আবার খিচুনি হতে থাকে এবং খিচুনি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সবাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে।
পুরুষ কিংবা মহিলা বোঝা যায় না মানুষটি বলল, “আরো একটা সমস্যা আছে।”
“কী সমস্যা?”
“সার্জারি করার ক্যাপসুলে মনে হয় সমস্যা আছে।”
“কেন?”
“গত সপ্তাহে সার্জারি করার সময় একটা মারা গেল মনে নাই?”
অন্য দুজন তখন মাথা নাড়ল। বলল, “সার্জারি করার নতুন ক্যাপসুল না আনা পর্যন্ত সার্জারি করা ঠিক হবে না।”
মায়ী মায়ী বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু তাহলে এই দুইটাকে কী করব?”
পুরুষটা বলল, “কেটে হৃৎপিণ্ড ফুসফুস কিডনি মগজ বের করে রেখে দিই। পরে কাজে লাগবে।”
মহিলাটা বলল, “হিমঘরে জায়গা নাই। গত যুদ্ধে কত মারা গেল মনে নাই?”
মায়ী মায়ী চোখ পাকিয়ে বলল, “তাহলে?”
যে মানুষটাকে দেখে বোঝা যায় না পুরুষ না মহিলা, সে বলল, “মেরে না ফেলে জীবন্ত রাখা ভালো। আজকাল জীবন্ত মানুষের দাম বেশি। বিজ্ঞানী লিংলি অনেক দাম দিয়ে জীবন্ত মানুষ কিনছে।”
মায়ী মায়ী বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ মায়ী মায়ী। সত্যি।”
“কী করে জীবন্ত মানুষ দিয়ে?”
“জানি না। শুনেছি মাথায় বাই ক্রেনিয়াল লাগায়। বাই ক্রেনিয়াল হচ্ছে দুইটা ক্রেনিয়াল। একটা দিয়ে তথ্য দেয়, আরেকটা দিয়ে বের করে।” মানুষটা আমাদের দেখিয়ে বলল, “এই দুজনকে লিংলির কাছে বিক্রি করে দিলে লাভ বেশি।”
মায়ী মায়ী বলল, “ঠিক আছে তাহলে।”
আমি আর টিশা বুকের ভেতর থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিলাম, আপাতত প্রাণে বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু কত দিন বেঁচে থাকব জানি না। কীভাবে বেঁচে থাকব সেটাও জানি না।
» ১০. দস্যুদল আমাকে আর টিশাকে
দস্যুদল আমাকে আর টিশাকে কীভাবে রাখবে সেটা নিয়ে আমাদের নানারকম চিন্তা ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের দুজনকে যেভাবে রাখা হলো সেটি আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। মায়ী মায়ী যতক্ষণ ট্রেইলারের ভেতর থাকে ততক্ষণ আমাদের গলায় শিকল বেঁধে তার টেবিলের সাথে বেঁধে রাখে। শুধু তাই না, মায়ী মায়ী মাঝে মাঝেই আমাদের দিকে তাকিয়ে জিবে চুক চুক শব্দ করতে করতে বলে, “তোদের মাথায় কেরেনিয়াল নাই! থাকলে তোদের একজনের মাথায় একটা কুকুরের সিস্টিম আরেকজনের মাথায় খেঁকশিয়ালের সিস্টিম লোড করে রাখতাম। তোরা দিনরাত খামচাখামচি কামড়াকামড়ি করতি-–দেখে কত আনন্দ হতো।”
এ ধরনের একটা কথা বলা হলে উত্তরে কী বলতে হয় আমাদের জানা নেই, তাই আমরা নিঃশব্দে মায়ী মায়ীর দিকে তাকিয়ে থাকি। মায়ী মায়ী আমাদের কখনো নাম ধরে ডাকত না। একজনকে ভাইরাস আরেকজনকে ব্যাকটেরিয়া ডাকত! আমাদের কাজ ছিল তার ফুট ফরমাশ খাটা, হাতের কাছে মায়ী মায়ী একটা লম্বা দড়ি রেখেছিল, কাজকর্মে উনিশ-বিশ হলে সে সেই দড়িটাকে চাবুকের মতো করে আমাদের মারত।
ট্রেইলার থেকে বের হবার সময় মাঝে মাঝে শিকলে বাঁধা অবস্থায় আমাদের দুজনকে পোষা জন্তুর মতো টেনে টেনে নিয়ে যেত। দস্যুদল দৃশ্যটি দেখে খুবই মজা পেত, আমাদের দুজনের দিকে তারা খাবারের টুকরো ছুঁড়ে দিত। আমরা সেগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে আমাদের পকেটে জমা করে রাখতাম।
মাঝে মাঝে আমাদের কোনো একটা গাড়ির এক্সেলের সাথে বেঁধে রাখত, আমরা গাড়ির ছায়ায় বসে দস্যুদলকে যেতে-আসতে দেখতাম। রাত্রে ঘুমানোর সময় আমাদের খাঁচার ভেতর ঢুকিয়ে উপরে ঝুলিয়ে রাখত। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো, আস্তে আস্তে কেমন জানি অভ্যাস হয়ে গেল।
দস্যুদল এক জায়গায় এক-দুই দিনের বেশি থাকত না, বেশির ভাগ সময়েই তারা রাস্তায় চলন্ত অবস্থায় থাকত। যখন তাদের কনভয় চলত তখনো তারা আমাদেরকে আঁচায় বন্ধ করে রাখত। আমরা মাটি থেকে অনেক উপরে ঝুলতে ঝুলতে যেতাম, খাঁচাটা ডানে-বামে দুলত, প্রথম প্রথম সেই দুলোনিতে আমরা বমি করে একাকার করে ফেলতাম, আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে গেল। শুধু অভ্যাস নয় আমরা