.
ছোট একটা খাঁচার ভেতরে হাত-পা ছড়িয়ে বসা যায় না, কাজেই ঘুমানোর কোনো প্রশ্নই আসে না, কিন্তু শেষ রাতের দিকে আমরা দুজনেই ঘুমিয়ে গেলাম। আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বিচিত্র দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম, খাড়া পাহাড়ের উপর দিয়ে দৌড়াচ্ছি। দুই পাশে খাড়া খাদ, একটু তাল হারালেই সেই খাদে পড়ব। কিছু বুনো পশু তাড়া করছে, আমি থামতে পারছি না। হঠাৎ একটা পশু আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং আমি পা পিছলে খাদের মাঝে পড়ে যাচ্ছি। আমি চমকে উঠে জেগে উঠলাম। দেখলাম দুজন দস্যু আমাদের খাঁচাটি নিচে নামাচ্ছে। টিশা মনে হয় এতটুকু ঘুমাতে পারেনি, চোখের নিচে কালি, চেহারায় এক ধরনের উদভ্রান্ত দিশেহারা ছাপ।
দস্যু দুজন খাঁচা খুলে আমাদের বের করে সামনের দিকে ধাক্কা দেয়। আমি পড়ে যেতে যেতে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিলাম। টিশা আর আমি পাশাপাশি গা ঘেঁষে হেঁটে যেতে থাকি, সামনে একটা বড় ট্রেইলার, তার দরজা খুলে আমাদের দুজনকে ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। ট্রেইলারের ভেতরে একটা টেবিলের পিছনে মায়ী মায়ী বসে আছে, টেবিলের উপর অনেকগুলো ঘোট টিউব। মায়ী মায়ী একটা টিউব বেছে নিয়ে হাত দিয়ে তার মাথার পেছনে ক্রেনিয়ালে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। সাথে সাথে তার শরীর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে, কয়েক মুহূর্ত সে চোখ বন্ধ করে রাখে তারপর জিব দিয়ে তৃপ্তির মতো একটা শব্দ করে আমাদের দুজনের দিকে তাকাল। আমি দেখলাম তার সবুজ চোখ দুটো আস্তে আস্তে প্রথমে হলুদ, গোলাপি হয়ে টকটকে লাল হয়ে উঠল। হঠাৎ করে তাকে মানুষ মনে না হয়ে রাক্ষুসি মনে হতে থাকে।
মায়ী মায়ী বলল, “আয়, কাছে আয়।”
আমি আর টিশা ভয়ে ভয়ে কাছে এগিয়ে গেলাম। মায়ী মায়ী হিস হিস করে বলল, “চিকি চিকি চিংড়া! তোদের মাথায় কেরেনিয়াল নাই কেন?”
টিশা বলল, “আমাদের মাথায় লাগায়নি।”
মায়ী মায়ী ধমক দিয়ে উঠল “কেন লাগায় নাই? কে লাগায় নাই?”
“আমাদের শহরে ষোল বছর হলে ক্রেনিয়াল লাগায়। আমাদের বয়স এখনো ষোল হয়নি।”
মায়ী মায়ী দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “যার মগজে কেরেনিয়াল নাই তার সাথে একটা জানোয়ারের কোনো পার্থক্য আছে? নাই? একটা জানোয়ার কিছু জানে? কিছু বুঝে? তোরা কিছু জানিস? বুঝিস? তোরা জানোয়ার! কিরি কিরি কিরি কিরি…”
মায়ী মায়ীর শরীরে কেমন যেন খিচুনির মতো হতে থাকে। কিছুক্ষণ পর খিচুনিটা থেমে যায়, চোখের রং লাল থেকে হলুদ হয়ে আবার সবুজ হয়ে যায়। সবুজ রঙের চোখ দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর লোল টানার মতো একটা শব্দ করে বলল, “তোদের দিয়ে আমি কী করব? তোরা একটা মাংসের দলা ছাড়া আর কিছু না! তোরা জানিস দুই আর দুই যোগ করলে কত হয়?”
আমরা মাথা নাড়লাম। মায়ী মায়ী বলল, “দিন কেমন করে রাত হয় জানিস? রাত কেমন করে দিন হয় জানিস? ইলেকট্রিসিটি কেমন করে হয় জানিস? অস্ত্র কেমন করে গুলি করে জানিস? বোমা কেমন করে ফাটে জানিস? মগজের ভেতরে কী আছে জানিস? বুকের ভেতর কী আছে জানিস? কেরেনিয়াল কেমন করে কাজ করে জানিস?”
আমরা উত্তর দেবার আগেই মায়ী মায়ী টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “কিছু জানিস না! কিছু জানিস না। চিকি চিকি চিকি চিকি…”
প্রচণ্ড রাগে তার শরীর কাঁপতে থাকে। মায়ী মায়ী আমাদের কাছে যে বিষয়গুলো জানতে চেয়েছে আমরা তার প্রত্যেকটা জানি, বই পড়ে শিখেছি কিন্তু আমরা সেটা বলার চেষ্টা করলাম না। কারণটা ব্যাখ্যা করতে পারব না কিন্তু আমার মনে হতে থাকে এই দস্যুদলের যদি ধারণা হয় আমরা কিছু জানি না, বুঝি না–পুরোপুরি অপদার্থ দুজন মানুষ তাহলে সেটাই আমাদের জন্য নিরাপদ।
মায়ী মায়ী হঠাৎ করে নিজের গলার কাছে কোথায় একটা চাপ দিল, তারপরে খনখনে গলায় বলল, “সিস্টিম পনের কোনখানে? মাজাভাঙা কানা লুলা সিস্টিম পনের আমার খাঁচার মাঝে আয়।”
এতক্ষণ আমাদের সাথে যে কথাগুলো বলছিল সেটা আমরা দুজন ছাড়া কেউ শোনেনি কিন্তু এই কথাগুলো সারা কনভয়ের সবাই শুনতে পেল। সিস্টেম পনের কথাটার অর্থ বুঝতে পারলাম, যাদের মাথায় সিস্টেম পনের ঢোকানো হয়েছে তাদেরকে সে ডাকছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই তিনজন মানুষ এসে হাজির হলো। একজন পুরুষ অন্যজন মহিলা, বাকি মানুষটি পুরুষ না মহিলা বোঝা গেল না। মানুষগুলো ট্রেইলারে ঢুকে মায়ী মায়ীর পাশে এসে দাঁড়াল। মহিলা সিস্টেম পনের জিজ্ঞেস করল, “কোনো সমস্যা মায়ী মায়ী?”
মায়ী মায়ী প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাথার পেছনে হাত দিয়ে তার ক্রেনিয়াল থেকে টিউবটা বের করে, টেবিলের উপর থেকে আরেকটা টিউব নিয়ে সেটা ক্রেনিয়ালে ঢুকিয়ে দিল। সাথে সাথে তার চোখগুলো কেমন যেন ঘোলা হয়ে যায় এবং তার সারা শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। সিস্টেম পনের ললাড করা মানুষগুলো মায়ী মায়ীর এই অবস্থা দেখে মোটেও বিচলিত হলো না–মনে হলো তারা এরকম দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত। মায়ী মায়ী একটু পরেই শান্ত হয়ে চোখ খুলে তাকাল, চোখের রং এখন টকটকে লাল।
যে মানুষটিকে দেখে পুরুষ না মহিলা বোঝা যায় না, সে জিজ্ঞেস করল, “মায়ী মায়ী, কোনো সমস্যা?”
মায়ী মায়ী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “না, কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলে এই মায়ী মায়ী নিজেই সেটা সমাধান করতে পারে। পারে না?”