ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, আতঙ্কিত, শীতার্ত অবস্থায় একটা খাঁচায় আটকা থেকে শূন্যে ঝুলতে ঝুলতে কেউ কখনো গান গাইবার কথা চিন্তা করে না। এটা বড়জোর একটা উৎকট রসিকতা হতে পারে। আমার কথা শুনে টিশা আমার নাকের উপর একটা ঘুষি মেরে বসলেও আমি অবাক হতাম না। কিন্তু টিশা আমার নাকে ঘুষি মারল না, জোছনার আলোতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সত্যি সত্যি খুবই মৃদু স্বরে গান গাইতে লাগল। একজন মহাকাশচারী তার প্রেমিকাকে পৃথিবীতে রেখে চাঁদের দিকে উড়ে যাচ্ছে, প্রেমিকা সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে জোছনার আলোকে বলছে তার প্রেমিকার কাছে একটা খবর পৌঁছে দিতে। খুবই করুণ একটা গান, টিশার গলায় সেটা আরো করুণ শোনাতে লাগল।
আমাদের খাঁচার নিচ দিয়ে একজন দস্যু যাচ্ছিল, গান শুনে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল, টিশা ভয় পেয়ে সাথে সাথে গান বন্ধ করে দিল।
নিচ থেকে দস্যুটি বলল, “কী হলো? থামলে কেন? গাও।” একজন মেয়ের কণ্ঠস্বর।
টিশা বলল, “গাইব?”
“হ্যাঁ। গাও। তোমার কণ্ঠস্বরে কম্পনের সুষম অবস্থান খুব ভালো।”
টিশা তখন আবার গাইতে শুরু করল। দস্যু মেয়েটি খাঁচার নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গানটি শুনল। তারপর একটা গাড়িতে হেলান দিয়ে বসে বলল, “এই মেয়ে, আরেকটা গান গাও।”
টিশা তখন আরেকটা গান শুরু করল, দস্যু মেয়েটি সেই গানটিও শুনল, কনকনে ঠান্ডা বাতাসে টিশা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিল, দস্যু মেয়েটি সেটাও লক্ষ করল। গান শেষ হবার পর জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কি খেয়েছ?”
টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “না।”
দস্যু মেয়েটি বলল, “তোমরা দাঁড়াও, আমি তোমাদের জন্য একটু খাবার, পানীয় আর দুটো গরম পোশাক নিয়ে আসি।”
কিছুক্ষণ পর দস্যু মেয়েটি সত্যি সত্যি আমাদের জন্যে শুকনো খাবারের প্যাকেট, পানীয়ের বোতল আর দুটো গরম পোশাক নিয়ে এল। আমাদের খাঁচাটা নিচে নামিয়ে সে শিকের ফাঁক দিয়ে খাবারের প্যাকেট, পানীয়ের বোতল আর গরম পোশাক দুটো ঢুকিয়ে দিল। আমরা উষ্ণতার ডায়ালে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ঠিক করে তাড়াতাড়ি পোশাক দুটো পরে নিলাম। খাবারের প্যাকেটটা খুলতে খুলতে আমি বললাম, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”
“তোমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল নেই, এই খাবার তোমাদের কাছে খুব বিস্বাদ মনে হবে।”
টিশা জিজ্ঞেস করল, “তোমরা খাবার সময় ক্রেনিয়াল দিয়ে মস্তিষ্কে খাবারের স্বাদের অনুভূতি তৈরি করে নাও?”
দস্যু মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আমাদের জীবন খুব আনন্দের, আমরা ক্রেনিয়াল দিয়ে যখন ইচ্ছা তখন মস্তিষ্কে আনন্দের অনুভূতি তৈরি করতে পারি।”
টিশা বলল, “তুমি ইচ্ছে করলেই তোমার ক্রেনিয়াল দিয়ে তোমার মস্তিষ্কে অপূর্ব একটা সঙ্গীতের অনুভূতি তৈরি করে নিতে পারতে। সেটা না করে তুমি কেন আমার গলায় গান শুনতে চাইলে?”
দস্যু মেয়েটি একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি জানি না। মনে হয় আমার স্মৃতিতে এরকম একটা মধুর স্মৃতি ছিল। মায়ী মায়ীর দলে যোগ দেবার পর সব পুরোনো স্মৃতি মুছে দিয়ে দস্যু হওয়ার স্মৃতি ঢোকানো হয়েছে, তারপরেও মনে হয় মস্তিষ্কের কোথাও এই ধরনের কিছু স্মৃতি লুকিয়ে আছে।”
টিশা বলল, “তুমি মোটেও অন্য দস্যুদের মতো নও।”
“আমার ক্রেনিয়াল দিয়ে সিস্টেম পাঁচ ডাউনলোড করেছে। সিস্টেম সাত ডাউনলোড করলে আমি অন্য দস্যুদের মতো হয়ে যাব।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি অন্য দস্যুদের মতো হতে চাও।”
দস্যু মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “হ্যাঁ। হতে চাই। সিস্টেম পাঁচ দিয়ে আনন্দের তীব্রতা বেশি করা যায় না। সিস্টেম সাত আট নয় দিয়ে আনন্দের তীব্রতা অনেক বেশি। মায়ী মায়ীর সিস্টেম হচ্ছে সতের। আমাদের আর কারো সতের নেই।”
টিশা জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেমন করে দস্যুদলে যোগ দিয়েছ?”
দস্যু মেয়েটি বলল, “আমার মস্তিষ্ক থেকে সেই স্মৃতি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি কোথা থেকে এসেছি আমি জানি না।” মেয়েটি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “তোমাদের মাথায় যদি ক্রেনিয়াল থাকত তাহলে তোমাদের স্মৃতিও মুছে দেওয়া হতো। এতক্ষণে তোমরাও দস্যু হয়ে যেতে।”
ঠিক কী জন্য জানি না আমি কেমন জানি শিউরে উঠলাম। মেয়েটা বলল, “তোমরা খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো। কাল সকালে তোমাদের নিশ্চয়ই অনেক ধকল সহ্য করতে হবে। ক্রেনিয়াল থাকলে কোনো সমস্যা হতো না।”
মেয়েটি যখন আমাদের খাঁচাটি উপরে তুলছে তখন টিশা জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”
“আমার নাম প্রিমা তিন। প্রিমা এক আর দুই আগে এসেছে, তাদের সিস্টেম এগারো।”
টিশা বলল, “প্রিমা তিন, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।” মেয়েটি বলল, “আমি যখন তোমার গান শুনছিলাম তখন খুব আশ্চর্য একটা ব্যাপার ঘটেছে। হঠাৎ করে আমার আগের নামটি মনে পড়েছে।”
“তোমার আগের নাম কী?”
“আমার আগের নাম রিয়ানা।”
টিশা বলল, “রিয়ানা খুব সুন্দর নাম।”
মেয়েটি খাঁচাটাকে উপরে তুলতে তুলতে বলল, “আমার মাথায় যখন আবার নতুন করে সিস্টেম ডাউনলোড করবে তখন আমি রিয়ানা নামটা ভুলে যাব। এই নামটির এখন আর কোনো গুরুত্ব নেই।”
আমি আর টিশা ছোট খাঁচাটার ভেতর বসে দেখলাম প্রিমা তিন নামের দস্যু মেয়েটি জোছনার আলোতে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটাকে দেখে কেমন যেন দুঃখী একটা মেয়ে মনে হতে থাকে।