তারপর মনে হয় সিস্টেম ডাউনলোড প্রক্রিয়াটা দেখার জন্যে মহিলাটি লরির একটা ধাতব অংশে বসে পড়ে। আমাদের দুজনকে ঘিরে কয়েকজন দস্যু, কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে ছোটাচ্চুটি করতে থাকে। বিচিত্র কিছু যন্ত্র নিয়ে আসা হয় এবং সেগুলোর সাথে অন্য যন্ত্র লাগিয়ে সেখান থেকে লম্বা লম্বা তার বের করে আনা হয়। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে আমি আর টিশা এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে যন্ত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে হয় মজা দেখার জন্যই বেশ কিছু দস্যু আমাদের দুজনকে ঘিরে দাঁড়াল। পাহাড়ের মতো বড় একজন দস্যু আমাকে ধরে দস্যুদলের নেতা মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “মায়ী মায়ী, ক্রেনিয়ালে কানেকশন দিব?”
মহিলাটির নাম মায়ী মায়ী নাকি তাকে এই নামে সম্বোধন করা হয় বুঝতে পারলাম না। মহিলাটি মাথা নাড়ল, বলল, “দাও। সিস্টিম ডাউনলোড কর।” তারপর মুখে লোল টানার মতো শব্দ করে বলল, “তিন নম্বর সিস্টিম দিবি।”
পাহাড়ের মতো দস্যুটি মাথা নেড়ে আমার চুলগুলো ধরে আমার মাথার পিছনে তাকাল, মনে হলো সেখানে ক্রেনিয়ালটা খুঁজল, কিন্তু না পেয়ে অবাক হয়ে বলল, “ক্রেনিয়াল কই?”
আমি বললাম, “আমার মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানো হয়নি।”
মানুষটি চিৎকার করে বলল, “কী বললি? মগজে ক্রেনিয়াল নাই?”
আমি মাথা নাড়লাম, “না।”
দস্যুদলের নেতা মহিলাটি যাকে মায়ী মায়ী বলে সম্বোধন করা হচ্ছে প্রায় লাফ দিয়ে উঠে আমার কাছে এসে আমার মাথার পেছনে দেখল, তারপর টিশার মাথার পিছনে দেখল। দুজনের কারো মাথাতেই ক্রেনিয়াল নেই, মায়ী মায়ী প্রথমে খুব অবাক হলো, তারপর রেগে উঠল, তারপর হঠাৎ শব্দ করে হাসতে শুরু করল! হাসতে হাসতে বলল, “এই কানা লুলা মাজা ভাঙা কুত্তার বাচ্চারা, তোরা শুনলে বেকুব হয়ে যাবি! দুইটা ইন্দুরের বাচ্চাকে ধরে এনেছি তাদের মাথায় কেরেনিয়াল নাই।” কোনো একটা বিচিত্র কারণে মায়ী মায়ী নামের মহিলাটি ক্রেনিয়াল উচ্চারণ করতে পারে না, এটাকে বলে কেরেনিয়াল! কথা শেষ করার আগেই মায়ী মায়ী অপ্রকৃতিস্থের মতো হি হি করে হাসতে থাকে। বিশাল স্পিকারে সেই বিচিত্র হাসি সারা শহরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
পাহাড়ের মতো মানুষটা বলল, “মায়ী মায়ী, এখন এই দুইটারে কী করব?”
“একটা খাঁচার ভেতরে আটকে রাখ।”
পাহাড়ের মতো মানুষটা সত্যি সত্যি আমাদের দুজনকে একটা খাঁচার ভেতরে ঢুকিয়ে খাঁচাটা একটা গাড়ি থেকে বের হওয়া ধাতব দণ্ড থেকে ঝুলিয়ে দিল। আমরা মাটি থেকে প্রায় দশ মিটার উপরে ঝুলতে থাকলাম।
উপর থেকে পুরো কনভয়টা দেখা যায়। সন্ধে নেমে আসছে, বিদঘুঁটে গাড়ির সামনে ছোট ছোট আগুন জ্বালানো হয়েছে, পুরো এলাকাটা ধোঁয়ায় ভরে গেছে। দস্যুদলের মানুষগুলো আগুন ঘিরে বসে হাসি-তামাশা করতে লাগল। আমি টিশার দিকে তাকিয়ে বললাম, “টিশা।”
“বলো।”
“এখানে কী হচ্ছে বুঝতে পারছ টিশা।”
“একটু একটু বুঝতে পারছি।”
“আমাদের এখন কী হবে বলে মনে হয়?”
টিশা বলল, “ডিটিউন হওয়া ভালো ছিল নাকি এটা ভালো হলো বুঝতে পারছি না।”
কথাটা মোটেও হাসির কথা নয় কিন্তু টিশা হঠাৎ হাসতে শুরু করল। আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “এরকম একটা অবস্থা হবে জানলে তুমি কি আমাকে উদ্ধার করতে আসতে?”
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “মনে হয় আসতাম।”
টিশা বলল, “চমৎকার। খুব খারাপ হলে দস্যু হয়ে থাকতে হবে। যাযাবর হতে গিয়ে দস্যু হয়ে গেলাম, খারাপ কী?”
কথা শেষ করে টিশা আবার হাসতে থাকে। আমি অবাক হয়ে এই বিচিত্র মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
০৯. অন্ধকার হওয়ার সাথে সাথে
অন্ধকার হওয়ার সাথে সাথে ঠান্ডা পড়ে গেল। আমাদেরকে একটা খাঁচার ভেতরে ভরে শূন্যে ঝুলিয়ে রেখেছে, সেখানে কনকনে ঠান্ডা বাতাসে আমি আর টিশা শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি। গত কয়েক ঘণ্টায় এত কিছু ঘটে গেছে যে আমাদের ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা মনেই থাকার কথা ছিল না কিন্তু কী কারণ কে জানে আমাদের ভয়ানক খিদে পেয়েছে। কেউ আমাদের মনে করে কোনো খাবার দেবে কি না বুঝতে পারছিলাম না। উপায় না দেখে নিচে দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা দস্যুকে ডেকে তাকে খাবারের কথা বলার চেষ্টা করলাম। দস্যুটা নিচে দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনল, তারপর রাস্তা থেকে একটা পাথর তুলে আমাদের দিকে ছুঁড়ে মারল, খাঁচার শিকে লেগে পাথরটা ভেঙে টুকরো টুকরো না হয়ে গেলে আমাদের কপালে দুঃখ ছিল।
আমরা তখন আর কাউকে কিছু বলার সাহস পেলাম না। খাঁচার ভেতরে শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে গুটিশুটি মেরে একজন আরেকজনকে ধরে একটু উষ্ণ হওয়ার চেষ্টা করতে করতে বসে রইলাম। রাত একটু গম্ভীর হওয়ার পর আকাশে একটা বড় চাঁদ উঠল। একসময় চাঁদ দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিতাম, এখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। চাঁদ কেন ওঠে, কেন বড় হয় ছোট হয়, কেন চন্দ্রগ্রহণ হয়, কেন চাঁদের একটি পৃষ্ঠই আমরা দেখি অন্যটা কেন দেখি না, এই সবকিছু কিছু বই পড়ে শিখেছি। এখন চাঁদ দেখতে ভালো লাগে। চাঁদের নরম আলোতে নিচে দস্যুদলের কনভয়টাকেও অন্য রকম দেখাচ্ছিল, কেন জানি মোটেও ভয়ংকর মনে হচ্ছিল না।
আমি টিশাকে ডাকলাম, “টিশা।”
“বলো।”
“কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখেছ?”
“দেখেছি।”
“একটা গান গাইবে?”