আমি আর টিশা হতবাক হয়ে কুকুরের মতো প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, কারণ প্রাণীটি একজন মানুষ। কোমরে জড়ানো এক টুকরো পলিমার ছাড়া শরীরে কোনো কাপড় নেই, মাথায় লম্বা চুল, মুখভর্তি দাড়িগোঁফ। শেকল দিয়ে আটকে রেখেছে বলে আমাদের কাছে আসতে পারছে না, দূর থেকে হিংস্র ভঙ্গিতে গর্জন করতে লাগল।
পুরুষ আর নারীটির হাতে তীব্র আলোর দুটো ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠল, তার আলোতে আমাদের চোখ পুরোপুরি ধাধিয়ে যায়। আমরা হাত দিয়ে চোখ দুটো ঢাকার চেষ্টা করলাম। পুরুষ মানুষটা বলল, “হাইয়ারে হাইয়া! চিকি চিকি চিকড়া।” মেয়েটা বলল, “একটাও পাই না। এখন দেখি এক জোড়া।”
পুরুষটা বলল, “শুধু এক জোড়া না। একটা বেটা একটা বেটি।”
কুকুরের মতো মানুষটা ছুটে আমাদের দিকে আসার চেষ্টা করে গরগর করে শব্দ করল। পুরুষ মানুষটা শিকলটা শক্ত করে ধরে রেখে বলল, “ইন্দুরের বাচ্চা ইন্দুর গর্ত থেকে বের হ তাড়াতাড়ি।”
আমি কথা বলার চেষ্টা করলাম, বললাম, “তোমরা কী চাও?”
আমার প্রশ্ন শুনে পুরুষ এবং মহিলাটা এমনভাবে হাসতে শুরু করল যেন আমি খুবই হাসির একটা কথা বলে ফেলেছি। পুরুষটা এগিয়ে এসে আমার চুল ধরে টেনে এনে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “কথা না বলে হাঁটা দে পচা ঘা। একবার মুখ খুললে তোরে আস্ত না নিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে ব্যাগে ভর্তি করে নিব।”
আমি আর কথা বলার চেষ্টা করলাম না। মানুষগুলো একটু ঘুরতেই আমি প্রথমবার তাদের পেছনে ক্রেনিয়ালের ধাতব গর্তগুলো দেখতে পেলাম। কুকুরের মতো মানুষটার পেছনেও ক্রেনিয়াল লাগানো তবে তার ক্রেনিয়ালে একটা টিউব ঢোকানো আছে। টিউবের পেছনে একটা বাতি জ্বলছে এবং নিভছে। নিশ্চয়ই তার মাথার ভেতরে সরাক্ষণ কোনো রকম তথ্য ঢোকানো হচ্ছে। একজন মানুষকে পুরোপুরি কুকুরের মতো তৈরি করে ফেলা নিশ্চয়ই খুব সহজ না। উল্টোটা কী সম্ভব? একটা কুকুরকে কি মানুষের মতো করা যাবে?
আমি অবশ্যি চিন্তা করার খুব বেশি সময় পেলাম না। তার আগেই দস্যুদলের বিশাল কনভয়ের মাঝে আমাদেরকে নিয়ে এসেছে। শহরের রাস্তায় দস্যুদলের বিশাল এবং বিদঘুঁটে গাড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। গাড়িগুলোর উপর নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, নানা ধরনের অস্ত্র। অনেকগুলো গাড়ির উপর বিশাল বিশাল স্পিকার, সেখান থেকে বিচিত্র এক ধরনের বাজনা বাজছে।
দস্যুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুরুষ এবং মহিলা প্রায় সমান সমান। বেশির ভাগই মাঝবয়সী, চেহারার মাঝে এক ধরনের নিষ্ঠুরতার ছাপ। শরীরে নানা ধরনের উল্কি, নাকের মাঝে জিবের মাঝে ধাতব রিং। মরুভূমির গরম আবহাওয়ার জন্যই কিনা কে জানে, তাদের শরীরে কাপড় খুব কম, নগ্নতা নিয়ে তাদের কোনো রকম সংকোচ আছে বলে মনে হয় না।
আমাদের দুজনকে ধরে যখন নিয়ে যাচ্ছে তখন অনেকেই আমাদের দেখার জন্য এগিয়ে এল। তারা আমাদের ধরে টিপে টুপে দেখল। চুল ধরে টানল, হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল, ঘাড়ে ধরে উঁচু করে ওজন আন্দাজ করার চেষ্টা করল। পেটে গুঁতো দিল, একজন মুখ হাঁ করে দাঁতগুলো দেখল। আমাদের মনে হতে লাগল আমরা বুঝি মানুষ নই, আমরা বুঝি জন্তু-জানোয়ার।
কনভয়ের পাশে দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছি তখন হঠাৎ করে স্পিকারে সেই খনখনে গলায় আওয়াজ শুনতে পেলাম, বিচিত্র দুর্বোধ্য এবং কেমন জানি ভীতিকর। মানুষটি চিৎকার করে বলতে লাগল, “চিকি চিকি চিংড়া! টিকি টিকি টিংড়া। দুইটা ইন্দুর ধরা পড়েছে। একটা নয় আধাটা না, আস্তো দুইটা ইন্দুর। কানা লুলা মাজাভাঙা কুত্তার বাচ্চারা যারা নিজের চোখে দুইটা ইন্দুর দেখতে চাস আমার খাঁচার মাঝে চলে আয়! আজকে খানি দানি হবে ফুর্তি ফার্তা হবে। মগজের মাঝে কেরেনিয়াল পরিষ্কার করে রাখবি! আরে রে রে চিকি চিকি চিংড়া! চিকি চিকি চিংড়া!”
আমাদের দুজনকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে একটা লরির সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। লরির ভেতর থেকে একজন মানুষ লাফিয়ে বের হয়ে এল। আমাদের কয়েক মুহূর্ত লাগল বুঝতে যে মানুষটি একজন মহিলা। মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। সারা শরীর বিচিত্র উল্কি দিয়ে ঢাকা। শরীরে ছোট ছোট দুই টুকরো নিও পলিমারের কাপড়। গলায় ধাতব একটা মালা, কোমর থেকে একটা যন্ত্র ঝুলছে, বাম হাতের সাথে একটা অস্ত্র স্ট্রাপ দিয়ে বাঁধা।
এই বিচিত্র মহিলাটি আমাদের দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, “চিকি চিকি চিকি চিকি চিংড়া চিংড়া!” সাথে সাথে পুরো শহরটি তার খনখনে গলার স্বরে কেঁপে উঠল। মনে হয় তার ভোকাল কর্ডে মাইক্রোফোন লাগানো হয়েছে, যে কথাটিই বলে, পুরো কনভয়ে সেটা শোনা যায়।
মহিলাটি নিশ্চয়ই দস্যুদলের নেতা। সে খপ করে টিশার কাঁধ ধরে নিজের কাছে টেনে আনল, তারপর তার মুখটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, কানের ভেতর উঁকি দিল, মুখ হাঁ করিয়ে ভেতরে দেখল। তারপর তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আমার দিকে তাকল, চোখের রং সবুজ, আমি অবাক হয়ে দেখলাম সবুজ চোখ দুটি দেখতে দেখতে লাল হয়ে গেল এবং সেই লাল চোখ দিয়ে মহিলাটি আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি এবং সেই ভয়ংকর চেহারার মহিলাটি হঠাৎ অপ্রকৃতিস্থের মতো হি হি করে হাসতে শুরু করল, আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম মহিলাটির দাঁতগুলো ধারালো এবং দুই পাশের দুটি দাঁত হিংস্র পশুর মতো বড় বড়। মহিলাটি হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে আমাকেও সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলল, “সিস্টিম ডাউনলোড।”