টিশা বলল, “এদিকেই তো আসছে। মনে হয় আমাদের শহরটা আক্রমণ করতে আসছে।”
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “আমাদের শহরটাকে? এই শহরে তুমি আর আমি ছাড়া কে আছে?”
“ওরা তো সেটা জানে না।”
আমি আর টিশা জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে রইলাম, ধীরে ধীরে গাড়িগুলোর আকার বোঝা যেতে শুরু করেছে, বিদঘুঁটে কদাকার বিশাল বিশাল গাড়ি। দস্যুদলের বাজনাটাও অনেক স্পষ্ট হয়েছে, ভয়ংকর এক ধরনের বাজনা, বুকের ভেতর এক ধরনের কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়।
আমি বললাম, “আমাদের এখনই শহর থেকে পালিয়ে যেতে হবে। দস্যুদল এখানে পৌঁছানোর আগেই অন্য কোথাও চলে যেতে হবে।”
টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “না। তার জন্য দেরি হয়ে গেছে। দস্যুদল ওদের টেলিস্কোপ, মোশান সেন্সর, ভিডি ট্রেসার সবকিছু দিয়ে এই শহরটাকে স্ক্যান করছে। আমরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে দেখে ফেলবে–তখন ওদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।”
আমি মাথা নাড়লাম, “ঠিকই বলেছ। আমাদের এখানেই লুকিয়ে থাকতে হবে। পুরোপুরি ধসে গেছে এরকম কোনো জায়গায় লুকিয়ে থাকি। এত বড় শহরে আমাদের কখনো খুঁজে পাবে না।”
আমি আর টিশা আর দেরি করলাম না। কিছু শুকনো খাবার আর কয়েকটা পানির বোতল নিয়ে শহরের এক প্রান্তে পুরোপুরি ধসে পড়া একটা বিল্ডিংয়ের কিছু ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ছোট একটা ঘুপচি ঘরে লুকিয়ে রইলাম। দস্যুদল শহরে ঢুকেই বুঝতে পারবে এটা জনমানবহীন পরিত্যক্ত একটা শহর। তখন শহরের যা কিছু আছে লুটপাট করে নিয়ে যাবে, আমাদের দুজনকে নিশ্চয়ই খোজার চেষ্টা করবে না।
ঘণ্টা খানেকের ভেতরেই দস্যুর দলটা আমাদের শহরে পৌঁছে গেল, ভয়ংকর একটা বাজনা থেকে আমরা সেটা বুঝতে পারলাম। দলটা শহরের ভেতরে ঘুরে বেড়াল, ইতস্তত কিছু গোলাগুলি করল এবং আমরা ছোট-বড় নানাধরনের কিছু বিস্ফোরণের শব্দ শুনলাম।
ভয়ংকর বাজনাটা হঠাৎ থেমে গেল এবং একজন হঠাৎ খনখনে গলায় কথা বলতে শুরু করল। মানুষটার কথা খুবই বিচিত্র, উচ্চারণ বিদঘুঁটে এবং কথা বলার সময় প্রত্যেকটা শব্দের শেষে হিসহিস করে এক ধরনের শব্দ করে। তার সব কথা আমরা বুঝতে পারলাম না, শুনলাম খনখনে গলায় বলল, “চিকি চিকি চিকি চিকিরি মুঙ্গা আবে কানা লুলা মাজা ভাঙা পার্টনার ক্ষান্তি দে। দম লে বোম ফাটা। আয় এই শহরটা গুঁড়া করে যাই। চিকিরি দুঙ্গা! মনে লয় এই শহরে কুনো ইন্দুর নাই, থাকলেও জানের ভয়ে টিংরি দিছে না হয় গর্তে ঢুকছে। আবে কানা লুলা মাজাভাঙা ভুঁড়ি ফাসা কুত্তার বাচ্চারা খুঁইজা বার কর কারা আছে। কলিজা প্যাকেট কইরা লয়া যাই। চিকি চিকি চিঙ্গিরা! কাম শুরু কর কুত্তার বাচ্চারা। দুনিয়াটা দখল না করলে শান্তি নাই। এখনো একটা নিউঁকিলিয়ার বুমা খুঁইজা পাইলাম না কামটা কী ঠিক হইল? কুত্তার বাচ্চারা তোরা করস কী? তোগো মগজে আমি কি কেরেনিয়াল লাগাই নাই? সেই মগজে রস দেই নাই? চিকি চিকি চিঙ্গিরা। যখন দরকার পড়ছে তোগো বিপদ আপদ বুমা গুলি বিজলি বাজলা ঘাউ কামুড় থেকে বাঁচাই নাই…”
মানুষটা এই ভাষায় খনখনে গলায় কথা বলেই যেতে লাগল–কথার মাঝে মাঝে দস্যুদলের লোকেরা চিৎকার করতে লাগল, হল্লা করতে লাগল। আমরা কথার কিছু বুঝতে পারলাম, বেশির ভাগ বুঝতে পারলাম না। তবে মোটামুটি একটি জিনিস বুঝতে পারলাম শহরে কোনো মানুষ থাকলে তাদেরকে খুঁজে বের করতে এই দস্যুদল খুবই ব্যস্ত। মানুষকে অবশ্যি মানুষ না বলে ইঁদুর বলছে। যে কোনো কারণেই জীবন্ত মানুষ এদের কাছে খুবই মূল্যবান।
আমি আর টিশা এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে ধসে যাওয়া বিল্ডিংয়ের ধ্বংসস্তূপের খুপরিতে অন্ধকারে মাথা খুঁজে পড়ে রইলাম। বাইরে নানা ধরনের শব্দ হইহল্লা এবং মাঝে মাঝেই গোলাগুলি এবং বিস্ফোরণের শব্দ। কান ফাটানো এক ধরনের বাজনা এবং তার সাথে বিদঘুঁটে স্বরে গান শুনতে পেলাম। খনখনে গলার মানুষের বিচিত্র ভাষার কথা এবং গালাগাল মাঝে মাঝেই শুনতে হচ্ছিল। সে নিশ্চয়ই এই দস্যুদলের নেতা, সে যখন কথা বলে তখন সবার কথাবার্তা হই হল্লা থেমে যায়।
আমরা কতক্ষণ এভাবে বসেছিলাম জানি না। হঠাৎ করে খুব কাছে থেকে মানুষের গলার শব্দ শুনতে পেলাম। একটা পুরুষ কণ্ঠ বলল, “এই যে এই দিকে গেছে। ইন্দুরের বাচ্চা এই দিকে গেছে।”
আমার বুকটা ধক করে উঠল, তাহলে কি আমাদের খোঁজ পেয়ে গেছে? কেমন করে পেল?
একটা নারীকণ্ঠ বলল, “কুত্তাটাকে শুকতে দাও। কুত্তাটা কে কে বের করে ফেলবে।”
আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। দস্যুদল একটা কুকুর নিয়ে এসেছে। কুকুরটা ঘ্রাণ এঁকে এঁকে আমাদের বের করে ফেলছে। আমি হাতে অস্ত্রটা টেনে নিলাম, টিশা তখন আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, ফিসফিস করে বলল, “না। অস্ত্র ব্যবহার কোরো না। দেখা যাক কী হয়।”
আমরা ঘাপটি মেরে বসে রইলাম, পুরুষ এবং মহিলাটি নিচু গলায় কুৎসিত গালি দিতে দিতে এগিয়ে আসতে থাকে এবং কিছুক্ষণের মাঝে ধ্বংসস্তৃপটা সরিয়ে আমাদের ঘুপচি ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। ভয়ংকর অস্ত্র হাতে একজন পুরুষ এবং নারী এবং তাদের হাতে শেকল দিয়ে বাঁধা একটা প্রাণী, আবছা অন্ধকারে শুধু অবয়বটা দেখা যায়, চেহারা বোঝা যায় না।
গলায় শেকল বাঁধা প্রাণীটা মাটিতে গন্ধ শুকে শুকে আমাদের কাছে এগিয়ে এসে গর্জন করে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং ঠিক তখন পুরুষ এবং মহিলাটি শিকল টেনে ধরে প্রাণীটাকে সরিয়ে আমাদের রক্ষা করল।