“মানুষের মস্তিষ্কের উপর একটা বই।”
মানুষের মস্তিষ্কের উপর একটা বই দেখে এত আনন্দিত হবার কী আছে, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, টিশার অনেক কিছুই আমি বুঝতে পারি না! টিশা তখন তখনই ভিডি টিউবে ঢুকিয়ে দিয়ে বইটা পড়তে শুরু করে। আমি ভেবেছিলাম তাকে নিয়ে বের হব, কাছাকাছি আরো একটা পানির ঝরনা পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে-সেই জায়গাটা একটু দেখে আসব। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে আপাতত সেই পরিকল্পনা বন্ধ রাখতে হবে।
টিশা কিছুক্ষণ বই পড়ে হঠাৎ করে আমার দিকে তাকাল, বলল, “রিহি তুমি বই পড় না কেন?”
“বই। আমি? বই?”
“হ্যাঁ।”
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, “আমার তো তোমার মতো বই পড়ার অভ্যাস হয়নি।”
“তার মানে তুমি কিছু জান না।”
“জানি। একটা তিতির পাখি কেমন করে ঝলসে খাওয়া যায় জানি। যব দিয়ে কীভাবে রুটি তৈরি করা যায় জানি। মাথার চুল লম্বা হয়ে গেলে কীভাবে কাটতে হয় জানি”
টিশা প্রায় ধমক দিয়ে বলল, “ঠাট্টা কোরো না। আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছি। তুমি ভেবেছিলে যোলো বছর বয়স হলে তোমার মাথায় ক্রেনিয়াল লাগাবে, তখন তুমি সবকিছু শিখে নেবে–কিন্তু তুমি আর কোনো দিন শহরে ফিরে যেতে পারবে না। যদি যাও তাহলে তোমার মাথায় মোটেও ক্রেনিয়াল লাগাবে না–তোমাকে ডিটিউন করে দেবে!”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “জানি।”
“তাহলে?”
“তাহলে কী?”
“তাহলে তুমি কেন বই পড়া শুরু কর না? তুমি কেন শিখতে শুরু কর না?”
আমি ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, “পৃথিবীতে এত কিছু শেখার আছে, আমি কোথা থেকে শুরু করব?”
টিশার মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আমাদের নতুন আবিষ্কার করা লাইব্রেরিটা দেখিয়ে বলল, “এখানে খুব মজার কিছু বইয়ের ক্রিস্টাল আছে।”
“কীরকম মজার?”
“প্রাচীনকালে ছেলেমেয়েরা মাথায় ক্রেনিয়াল লাগিয়ে শিখত না। তারা নতুন কিছু শেখার জন্য স্কুলে যেত। কলেজে যেত। সেখানে শিক্ষকেরা তাদের বই থেকে শেখাত। কোন বয়সে কী শিখতে হবে সেগুলো ঠিক করে রাখা ছিল। সেই বইগুলো এই লাইব্রেরিতে আছে, তুমি সেই বইগুলো দিয়ে শুরু করতে পার।”
আমার আসলে টিশার মতো বই পড়ে পড়ে নতুন কিছু শেখার কোনো আগ্রহ নেই। শহরে যখন ছিলাম তখন জীবনটা ছিল খুবই বাঁধাধরা আনন্দহীন ছোট একটা জীবন। টিশার সাথে যাযাবর হয়ে যাবার পর এখন জীবনটা হয়েছে অনেক চমকপ্রদ। শহর থেকে বের হয়ে এই যাযাবর হয়ে যাবার আগে আমি জানতাম না একটা পাখির ডাক শুনেই বোঝা যায় পাখিটা সঙ্গী খুঁজছে। আমি জানতাম না হিংস্র পশু আসলে মোটেও হিংস্র নয়-যখন তাদের খিদে পায় শুধু তখন তারা অন্য কোনো প্রাণীকে হত্যা করে খায়। বই না পড়েই আমি এগুলো শিখেছি কিন্তু টিশার ধারণা এই জিনিস শিখে লাভ নেই! জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখতে হবে, গণিতের জটিল সমীকরণের সমাধান করা শিখতে হবে, তা না হলে একজন মানুষ নাকি মূর্খ থেকে যায়। আমার মূর্খ হয়ে থাকতে কোনো আপত্তি নেই কিন্তু টিশাকে সেটা বোঝাতে পারি না!
শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি টিশা আমাকে দিয়ে বই পড়াতে শুরু করল। প্রথম প্রথম কিছু একটা পড়ে সেটা বুঝতে আমার একটু সমস্যাই হতো কিন্তু আস্তে আস্তে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। গণিতের সমীকরণ সমাধান করতে শুরু করলাম। অণুপরমাণুর গঠন শিখে গেলাম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য জানতে শুরু করলাম। প্রাণিজগতের জিনেটিক কোড জেনে গেলাম, গাড়ির ইঞ্জিন কেমন করে কাজ করে জেনে গেলাম। মস্তিষ্কে ক্রেনিয়াল না লাগিয়েই যে সবকিছু জেনে যাওয়া যায় আমি সেটা বিশ্বাস করে যখন সত্যি সত্যি অনেক আগ্রহ নিয়ে রীতিমতো টিশার সাথে প্রতিযোগিতা করে লেখাপড়া শুরু করেছি, ঠিক তখন কয়েক ঘন্টায় আমাদের সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল।
আমরা একটা দস্যুদলের হাতে বন্দি হয়ে গেলাম।
০৮. বিকেলবেলা আমি আর টিশা
বিকেলবেলা আমি আর টিশা লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করছিলাম। একটা প্রোটনের কাছে এনে একটা ইলেকট্রন ছেড়ে দিলে সেটা কেন প্রোটনের ভেতর পড়ে না গিয়ে একটা হাইড্রোজেনের পরমাণু হয়ে যায় সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ তর্ক করে আমি লাইব্রেরির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছি তখন হঠাৎ মনে হলো বহুদূরে একটা ধূলিঝড় শুরু হয়েছে। আমি ধূলির ঝড়টার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে নিজের ভেতরে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করি। এটা কি সত্যিই ধূলিঝড় নাকি একটা কনভয়? দস্যুদলের কনভয়?
আমি টিশাকে ডাকলাম, “টিশা এখানে এসে দেখো!”
আমার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল যেটা শুনে টিশা ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী?”
“মনে হয় একটা কনভয় এদিকে আসছে।”
টিশা জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল বহু দূরে ধূলি উড়ছে, সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “হ্যাঁ! একটা কনভয়।”
“কার কনভয়?” টিশা নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলল, “দস্যুদলের।”
“কেমন করে বুঝলে দস্যুদল?”
“ওদের বাজনা শুনতে পাচ্ছ না?”
আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম এবং সত্যি সত্যি বহুদূর থেকে একটা বাজনার শব্দ শুনতে পেলাম, কেমন যেন আতঙ্কের বাজনা।
টিশা বলল, “সব দস্যুদলের নিজস্ব বাজনা থাকে। যখন কোথাও আক্রমণ করতে যায় এরকম বাজনা বাজাতে বাজাতে যায়।”
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “ওরা কাকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে?”