আমি বললাম, “আমি জানি না। নিশ্চয়ই কিছু একটা করেছিল কুনিল। শুধু শুধু তো একজনকে ডিটিউন করে না।”
টিশা মুখ শক্ত করে বলল, “আমি বলব কুনিল কী করেছিল?”
“কী করেছিল?”
“প্রশ্ন করেছিল। কুনিল প্রশ্ন করেছিল।”
“কী প্রশ্ন করেছিল?”
“কী প্রশ্ন করেছিল সেটা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়-কুনিল প্রশ্ন করেছিল সেটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। এই শহরে কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। প্রশ্ন করলেই ডিটিউন করে দেওয়া হবে।”
আমি টিশার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম, একটু পরে বললাম, “কুনিল তো তার প্রশ্নের উত্তর পেয়েই যেত। আর এক বছর পরেই তো ওর মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানো হতো।”
টিশা আবার শব্দ করে হাসতে থাকে, আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম তার হাসিতে কোনো আনন্দ নেই। টিশা যেভাবে হঠাৎ হাসতে শুরু করেছিল ঠিক সেভাবে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, “তুমি সত্যিই বিশ্বাস কর মাথায় ক্রেনিয়াল লাগালে আমরা সব প্রশ্নর উত্তর পেয়ে যাব?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেন পাব না?”
“যাদের মাথায় ক্রেনিয়াল লাগিয়েছে তারা সবকিছু জানে?”
“একশবার জানে। মনে আছে মাহার কথা? মাহা কি জেনারেটরের কিছু জানত? জানত না। এখন শহরের সব জেনারেটর মাহা দেখে-শুনে রাখে। নষ্ট হবার আগে ঠিক করে ফেলে।”
টিশা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “মাহার মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানোর আগে সে কী করত তোমার মনে আছে?”
আমি আলাদা করে মনে করতে পারলাম না, বললাম, “কী করত?”
“গান গাইত। দিনরাত গুনগুন করে গান গাইত।”
গান গাওয়ার সাথে ক্রেনিয়ালের কী সম্পর্ক আমি বুঝতে পারলাম না, জিজ্ঞেস করলাম, “গান গাইলে কী হয়?”
“এখন মাহা গান গায় না। মুখ শক্ত করে জেনারেটর ঠিক করে। জেনারেটর ছাড়া মাহা আর কিছু জানে না।”
“তাতে কী হয়েছে?”
টিশা একটু অধৈর্য গলায় বলল, “ক্রেনিয়াল লাগানোর আগে মাহা ছিল মানুষ। এখন মাহা একটা রোবট।”
টিশার কথা শুনে আমি এবারে শব্দ করে হেসে উঠলাম। বললাম, “টিশা, তুমি এবারে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছ। মাহা মোটেও রোবট না। মাহা খুবই হাসিখুশি মানুষ।”
টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। একটু বেশিই হাসিখুশি।”
“মানে?”
“একজন সত্যিকার মানুষের মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। মাথায় ক্রেনিয়াল লাগালে তার কোনো দিন মন খারাপ হয় না।”
“সেটা দোষের কিছু?”
“বিচুরিয়াস নামে একটা নেশা করার ড্রাগ আছে। সেটা খেলে খুবই আনন্দ হয়। তুমি বাকি জীবন প্রত্যেকদিন একটু করে বিচুরিয়াস খাবে? এই একটুখানি?”
“কেন? ড্রাগ কেন খাব?”
“তাহলে তোমার প্রত্যেকদিন খুব আনন্দ হবে।”
টিশা কী বলতে চাইছে হঠাৎ করে আমি বুঝতে পারলাম, বললাম, “তোমার ধারণা মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানো আর ড্রাগ খাওয়া এক জিনিস?”
“যদি ক্রেনিয়াল লাগিয়ে একটা মানুষের স্বভাবটাই বদলে দেয় তাহলে আমার কাছে একই জিনিস।”
“কিন্তু কিন্তু আমি কেন জানি বাক্যটা শেষ করতে পারলাম। যে কথাটি বলতে চাইছিলাম হঠাৎ করে মনে হলো সেই কথাটা অর্থহীন কথা, গুরুত্বহীন কথা।
টিশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু কী? বলো?”
আমি অনিশ্চিতের মতো বললাম, “যদি মাথায় ক্রেনিয়াল লাগিয়ে একটা মানুষকে হাসিখুশি মানুষে তৈরি করা যায়, ভালো মানুষে তৈরি করা যায়, তাকে যদি নতুন কিছু শেখানো যায় তাতে দোষের কী আছে?”
টিশা আঙুল দিয়ে তার মাথাটা দেখিয়ে বলল, “আমার এই মাথায় একশ বিলিয়ন নিউরন আছে। এই একশ বিলিয়ন নিউরন আমি আমার মতো করে কন্ট্রোল করতে চাই। কোনো যন্ত্র দিয়ে সেটা কন্ট্রোল করতে চাই না।”
মাথার ভেতরে একশ বিলিয়ন নিউরন আছে সেটা আমরা কেউ জানি না। টিশা জানে, কেমন করে জানে?
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। টিশার দিকে তাকিয়ে আমি বুকের ভেতর কেমন জানি ভয়ের একটা কাঁপুনি অনুভব করি। কী বলছে এসব টিশা?।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “আগে মানুষ স্কুলে। যেত, কলেজে যেত, ইউনিভার্সিটিতে যেত, নতুন কিছু শিখত। যেটা জানত না সেটা গবেষণা করে জেনে নিত। কিন্তু এখন তো সেই নিয়ম আর নেই। এখন তো কেউ কিছু শেখে না। যখন বয়স ষোলো হয়। তখন তার মাথায় ক্রেনিয়াল লাগিয়ে যেটা দরকার সেটা শিখিয়ে দেয়।”
টিশা বলল, “আমি জানি।”
“তাহলে? তাহলে তুমি যদি মাথায় ক্রেনিয়াল না লাগাও তুমি কিছু জানবে না। কিছু শিখবে না। অশিক্ষিত হয়ে থাকবে। মূর্খ হয়ে থাকবে।”
টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “আমি অশিক্ষিত মূর্খ না। ভিডি টিউবে বই পড়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি।”
আমি বললাম, “কিন্তু সত্যিকারের কিছু শেখনি। সত্যিকারের কিছু শিখতে হলে মাথায় ক্রেনিয়াল লাগাতে হয়।”
টিশা বলল, “ সেটা সবাই বলে কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না।”
“তাহলে তুমি কী বিশ্বাস কর?”
টিশা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি বিশ্বাস করি মাথায় ক্রেনিয়াল না লাগিয়ে শুধু বই পড়ে সবকিছু শেখা সম্ভব। তা ছাড়া আমার মনে হয়, কী হয় অশিক্ষিত আর মূর্খ হয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দিলে? কেন একটা যন্ত্রের হাতের পুতুল হয়ে বেঁচে থাকতে হবে?”
আমি টিশার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, বললাম, “তুমি এসব কী বলছ টিশা!”
টিশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তো অন্য কাউকে বলছি না রিহি! তোমাকে বলছি। তোমাকেও কি আমার মনের কথাগুলো বলতে পারব না?”