.
আমি টিশার দিকে তাকিয়ে বললাম, “এই দেখো প্রাণীটাকে অচেতন করে রেখেছি। আমাদের খাবারের অভাব হলে এটা খেতে পারি।”
টিশা বলল, “আমি প্রাণীটাকে দেখতে চাই।”
আমি আলো জ্বালিয়ে প্রাণীটার কাছে গেলাম, কুকুরের মতো দেখতে একটা প্রাণী। ঘাড়ের কাছে বড় বড় লোম, অচেতন হওয়ার পরও চোখ দুটো খোলা, মুখে ধারালো দাঁত।
টিশা বলল, “প্রাণীটা যথেষ্ট তাজা। এটা নিয়মিত খেতে পায়।”
ঠিক তখন আমার মাথায় একটা চিন্তা খেলা করে গেল। আমি উত্তেজিত গলায় বললাম, “টিশা।”
“কী হয়েছে?”
“বেঁচে থাকার জন্য এই প্রাণীটাকে পানি খেতে হয় না?”
“হ্যাঁ হয়।”
“তার মানে মাঝে মাঝেই এই প্রাণীটা কোথাও না কোথাও পানি খেতে যায়।”
টিশা এক ধরনের উত্তেজনা নিয়ে আমার দিকে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারল না, তারপর বলল, “যদি আমরা এটার পিছু পিছু যাই তাহলে সেটা কোথায় পানি খেতে যায় খুঁজে বের করতে পারব?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ।”
“আমাদের কাছে যদি ট্রাকিওশান থাকত তাহলে আমরা এটার শরীরে লাগিয়ে দিতাম। কোথায় যায় বের করতে পারতাম!”
আমি বললাম, “আমাদের কাছে ট্রাকিওশান আছে।”
টিশা অবাক হয়ে বলল, “ট্রাকিওশান আছে?”
“হ্যাঁ, একটু প্রাচীন। তোমার পছন্দ হবে কি না জানি না!” বলে আমি আমার ব্যাগ থেকে সুপার পলিমারের একটা দড়ি বের করে টিশার হাতে দিয়ে বললাম, “এটা হবে আমাদের ট্রাকিওশান! প্রাণীটার গলায় দড়ি বেঁধে রাখব, দড়ির অন্য মাথা ধরে আমরা এটার পিছু পিছু যাব!”
আমি কী বলছি বুঝতে টিশার এক মুহূর্ত সময় লাগল। যখন বুঝতে পারল তখন সারা শরীর দুলিয়ে সে হি হি করে হাসতে লাগল। এই মেয়েটা যখন হাসে তখন আমার বুকের ভেতর কী যেন ওলটপালট হয়ে যায়–কোনো দিন সেটা টিশাকে বলতে পারব বলে মনে হয় না।
সকালবেলার দিকে কুকুরের মতো দেখতে প্রাণীটা জেগে উঠে নড়াচড়া শুরু করল। আমরা সেটাকে একটা বড় পাথরের সাথে বেঁধে রেখেছি। ইচ্ছে করে সেটাকে ভোলা জায়গায় রেখেছি–ভয়ংকর রোদে নিশ্চয়ই প্রচণ্ড তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠবে, তাই যখন ছেড়ে দেব তখন নিশ্চয়ই প্রথমে পানি খেতে যাবে! গলার দড়ি ধরে তখন আমরা পিছু পিছু যাব!
আমি আর টিশা পাথরের ছায়ায় বসে অপেক্ষা করতে থাকি। মরুভূমির প্রচণ্ড রোদে চারিদিক ধিকিধিকি করে জ্বলছে, প্রাণীটা দীর্ঘ সময় নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেছে, না পেরে শেষ পর্যন্ত বালুতে মুখ ডুবিয়ে নির্জীবের মতো বসে আছে। প্রাণীটাকে দেখে আমাদের মায়া হচ্ছিল কিন্তু কিছু করার নেই। রোদ কমে না আসা পর্যন্ত আমরা এই প্রাণীটাকে ছেড়ে দিতে পারব না।
সূর্য ঢলে যাবার পর আমরা পাথর থেকে দড়ির বাঁধন খুলে প্রাণীটাকে যেতে দিলাম। সেটা ধুকে ধুকে এগোতে লাগল। আমি আর টিশা দড়ির অন্য মাথা ধরে সেটার পিছু পিছু যেতে থাকলাম। আমাদের ধারণা ভুল নয়। প্রাণীটা সত্যি সত্যি শুকনো বালু, পাথরের স্থূপ পার হয়ে দীর্ঘ সময় হেঁটে হেঁটে গাছপালা ঢাকা একটা জায়গায় এসে হাজির হলো। বড় একটা পাথরের ফাঁক দিয়ে সেখানে ঝিরঝির করে পানি পড়ছে, পৃথিবীতে এর থেকে সুন্দর কোনো দৃশ্য আছে বলে আমার জানা নেই।
আমরা প্রাণীটিকে প্রাণ ভরে পানি খেতে দিলাম। তারপর তার গলার বাঁধন কেটে সেটিকে ছেড়ে দিলাম। প্রাণীটি পাথরের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে গাছপালার ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি আর টিশা তখন ছোট জলাশয়ের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। গত কয়েক দিন হিসাব করে প্রত্যেক ফোঁটা পানি খেয়েছি, এখন শুধু যে যত ইচ্ছে পানি খেতে পারব তা নয়, ইচ্ছে করলে টলটলে পানিতে সারা শরীর ডুবিয়ে শুয়ে থাকতে পারব।
পানির এই ছোট ঝরনাটা পেয়ে যাবার পর আমাদের বেঁচে থাকার আর কোনো সমস্যা থাকল না। শুধু আমি আর টিশা যে পানির জন্য এখানে এসেছি তা নয়, এই এলাকায় সব পশুপাখি এখানে পানি খেতে আসে। এত দিন আমরা মানুষের জন্য তৈরি করা বিশেষ ধরনের খাবার ছাড়া আর কিছু খাইনি, কিন্তু এখন ইচ্ছে করলে আমরা পশুপাখি ধরে আগুনে ঝলসে খেতে পারব–একসময় তো মানুষ এভাবেই বেঁচে ছিল, আমরা কেন পারব না?
পানির এই ঝরনায় যেহেতু সব রকম জন্তু-জানোয়ার আসে, তার মাঝে সত্যিকারের হিংস্র পশুও থাকতে পারে, তাই আমরা এর কাছাকাছি না থেকে একটু দূরে একটা বড় পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিলাম। বিকেলের দিকে সূর্যের তেজ কমে এলে আমরা মোটর বাইকে করে আশেপাশের এলাকায় পরিত্যক্ত একটা শহর খুঁজে বেড়াতাম। খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত একটা শহর খুঁজে পেয়েছি। এক সময় নিশ্চয়ই অনেক মানুষ থাকত। একটা শহরের মানুষের থাকার জন্য যা যা থাকা দরকার তার সবই আছে। বেশির ভাগ ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে গেছে, কিন্তু কিছু কিছু বাসা একেবারে পুরোপুরি অক্ষত। দেখে মনে হয় বুঝি বাসার মানুষগুলো বাইরে গেছে, এক্ষুনি ফিরে আসবে।
এই শহরে যে জিনিসটা পেয়ে টিশার আনন্দের সীমা থাকল না সেটি হচ্ছে বিশাল একটা লাইব্রেরি। ভেতরে সারি সারি ভিডি টিউব সাজানো। শেলফে ছোট ছোট ক্রিস্টালে অসংখ্য বই। টিশা লোভাতুরের মতো সেই বইগুলোতে চোখ বুলাতে থাকে।
একদিন একটা বই দেখে টিশা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কী?”