টিশা তাকাল না। আমি আরো একটু পানি তার মুখে ঢেলে দিলাম, তখন সে প্রথমবার একটু নড়ে উঠল, তার ঠোঁট দুটো একটু কেঁপে উঠল। সে সাবধানে চোখ খুলে তাকাল, আমি তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বললাম, “টিশা! দেখো আমি রিহি!”
টিশা ফিসফিস করে বলল, “রিহি?”
“হ্যা”
টিশা বিড়বিড় করে বলল, “স্বপ্ন এটা স্বপ্ন। এটা সত্যি না।” তারপর আবার তার চোখ বন্ধ করল।
আমি আবার চিৎকার করে বললাম, “এটা স্বপ্ন না টিশা। এটা সত্যি, এই দেখো আমি এসেছি।”
টিশা আবার চোখ খুলে তাকাল, তারপর ফিসফিস করে বলল, “এটা সত্যি?”
“হ্যাঁ, এটা সত্যি।”
“তুমি সত্যি?”
“হ্যাঁ, আমি সত্যি। আমাকে ছুঁয়ে দেখো।”
টিশা তার ডান হাতটা একটুখানি তুলে আমাকে ধরার চেষ্টা করল, পারল না। তখন আমি তার হাতটা শক্ত করে ধরলাম। টিশা বলল, “আমি বেঁচে আছি? আমি মরে যাইনি?”
“না, তুমি মরে যাওনি টিশা। তুমি বেঁচে আছ।”
এই প্রথম টিশা সত্যিকারভাবে আমার চোখের দিকে তাকাল, তারপর বলল “রিহি।”
“বলো টিশা।”
“তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?”
“না। আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না।”
“তুমি আর আমি যাযাবর হয়ে যাব?”
এই প্রথম আমি একটু হাসলাম, বললাম, “আমি আর তুমি যাযাবর হয়ে গেছি টিশা!”
০৭. টিশা গাড়ির ড্রাইভারের সিটে বসে
দ্বিতীয়পর্ব
০৭.
টিশা গাড়ির ড্রাইভারের সিটে বসে চিৎকার করে বলল, “কানেকশন দাও।”
আমি গাড়ির নিচে শুয়ে ইঞ্জিন থেকে বের করে আনা দুটি তার ধরে রেখেছিলাম। ইনসিলুটেড তারের শেষ মাথা ঘষে তার ধাতব অংশ বের করে রাখা আছে, টিশা তার বই পড়ে পড়ে বের করেছে এই দুটি তার ইঞ্জিন স্টার্ট করার মুহূর্তে স্পর্শ করলে মোটর চালু করার প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাবে। আমি এতটা নিশ্চিত নই, তারপরেও টিশার উৎসাহের কারণে পরীক্ষাটা করতে রাজি হয়েছি। সত্যি সত্যি গাড়িটা চালু হয়ে যেন সেটা আমার উপর দিয়ে চলে না যায় সেজন্য চাকাগুলোর মাঝখানে শুয়েছি। টিশা যখন কানেকশন দিতে বলবে তখন কানেকশন দিতে হবে।
আমি গাড়ির নিচে শুয়ে চিৎকার করে বললাম, “দিব কানেকশন?”
“হ্যাঁ দাও।”
আমি দুটো তার ছোঁয়ানো মাত্রই একটা ভয়ংকর স্পার্ক হলো এবং পুরো গাড়িটা মনে হয় জীবন্ত প্রাণীর মতো লাফিয়ে উঠে আমার উপর দিয়ে ছুটে বের হয়ে সামনে একটা বিল্ডিংয়ে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে ভয় পাওয়া গলায় বললাম, “এটা কী হলো? টিশা? তুমি ঠিক আছ?”
আমি টিশার হাসির শব্দ শুনতে পেলাম, হঠাৎ করে একটা গাড়ি চালু হয়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছুটে গিয়ে যদি কোনো কিছুতে ধাক্কা খেয়ে থেমে যায় তাহলে তার ভেতরে কোন বিষয়টা হাসির আমি বুঝতে পারলাম না। টিশা গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগল। আমি একটুখানি আতঙ্কিত এবং অনেকখানি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কী হলো, তুমি হাসছ কেন?”
“তুমি যদি তোমাকে দেখতে তাহলে তুমিও হাসতে! মাটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে আছ, চোখ-মুখে একসাথে ভয়, অবিশ্বাস আর বিস্ময়!”
আমিও হাসলাম, বললাম, “তোমাকে বোঝা খুব মুশকিল টিশা।”
টিশা হঠাৎ করে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, “অন্যদের জন্যে সেটা সত্যি হতে পারে রিহি-তোমার জন্য না! তুমি আমাকে বুঝতে পেরেছ বলে আমি এখনো বেঁচে আছি। টিশা মাইনাস একটা আঙুল, কিন্তু পুরোপুরি আমি। তুমি যদি এসে আমাকে না বাঁচাতে তাহলে এত দিনে আমার হাড়গোড়ও বনের পশুরা চিবিয়ে খেয়ে ফেলত।”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “বনের পশুকে বেশি গালিগালাজ করো না–ওদের জন্য আমরা এখনো টিকে আছি!”
টিশা মাথা নাড়ল এবং হঠাৎ করে আমরা দুজনেই চুপ করে গেলাম। মরুভূমির পাথরের আড়ালে মৃতপ্রায় টিশাকে উদ্ধার করে শেষ পর্যন্ত এই নির্জন পরিত্যক্ত শহরটাতে মোটামুটি নিরাপদ আশ্রয়টা খুঁজে পেতে আমাদের কম কষ্ট করতে হয়নি।
.
আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে টিশাকে খুঁজে বের করে তাকে একটু সুস্থ করে তুলতে তুলতে আমার পানির পুরো ভান্ডার প্রায় শেষ হয়ে গেল। এক রাতে দুজন যখন একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে রেখে রাতের মরুভূমির তীব্র শীত থেকে উদ্ধার পাবার চেষ্টা করছি। তখন হঠাৎ করে আমাদের সামনে একটা বুনো প্রাণী এসে দাঁড়াল, অন্ধকারে তার পুরো আকারটা বোঝা যায় না, শুধু চোখ দুটো জ্বলন্ত কয়লার মতো জ্বলছে। টিশা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল “প্রাণীটা আমাদের দেখে যাচ্ছে, আমরা মরে গেলে আমাদের ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে।”
আমি কোনো কিছু না ভেবেই বললাম, “এত সোজা নয়! আমাদের খাবার শেষ হয়ে গেলে আমরাই বরং এটাকে ধরে খাব।”
টিশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এই প্রাণীটাকে খাবে?”
“সমস্যা কী? আগে কি মানুষ পশুপাখি ধরে কেটেকুটে রান্না করে খেত না? সব সময়েই কি এরকম শুকনো খাবার ছিল?”
টিশা কোনো কথা না বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তখন সেই প্রাণীটা আরো একটু সামনে এগিয়ে এল, আস্তে আস্তে সেটার সাহস বেড়ে যাচ্ছে। টিশা হাত নেড়ে সেটাকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল, প্রাণীটা এক পা পিছিয়ে গেল কিন্তু সরে গেল না। অন্ধকারে তার জ্বলন্ত চোখ নিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। টিশা বলল, “এটাকে সরিয়ে দাও, আমার ভালো লাগছে না।”
আমি বললাম, “দিচ্ছি।” তারপর শহরের সেন্ট্রির কাছ থেকে কেড়ে আনা অস্ত্রটা হাতে নিয়ে কীভাবে সেটা ব্যবহার করতে হয় বোঝার চেষ্টা করলাম। উপরে একটা ডায়াল, সেটার পাশে কোন মাত্রার বিস্ফোরক ব্যবহার করতে হবে সেটি লেখা। নির্বোধ প্রাণীটাকে বিস্ফোরক দিয়ে হত্যা করার কোনো ইচ্ছে নেই, শুধু ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দিতে চাইছি। ডায়ালটার শেষে ছোট করে লেখা ট্রাংকিউলাইজার-যার অর্থ এটাকে প্রাণে মারবে না কিন্তু অচেতন করে ফেলবে। পরীক্ষা করার জন্য এই সেটিংটা খারাপ না। আমি ডায়ালটা ট্রাংকিউলাইজারে টেনে এনে প্রাণীটার দিকে অস্ত্রটা তাক করে ট্রিগারটা টেনে ধরলাম, ধুপ করে একটা চাপা শব্দ হলো আর প্রাণীটা কেমন যেন লাফিয়ে উঠে ছোট একটা যন্ত্রণার শব্দ করল। তারপর ঘুরে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করল কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না, কয়েক পা গিয়েই পা ভেঙে পড়ে গেল।