আমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না, হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পরও পুরোপুরি জেগে উঠতে আমার খানিকক্ষণ সময় লাগে, আজকে কিন্তু আমি মুহূর্তে পুরোপুরি জেগে উঠলাম। পূর্ব আকাশে সূর্য উঠে দিগন্তের উপরে চলে এসেছে। চারিদিকে একটা নরম আলো, আমি জানি দেখতে দেখতে এটা ভয়ংকর উত্তপ্ত একটা দিনে পাল্টে যাবে। আমি আমার খাবারের প্যাকেট থেকে এক টুকরো শুকনো রুটি আর প্রোটিনের টুকরো বের করে চিবিয়ে খেয়ে নিলাম। তারপর পানির বোতল থেকে খুব সাবধানে দুই ঢোক পানি খেলাম। তারপর মোটর বাইকে উঠে সেটা নিয়ে ছুটে চলোম।
টিশার টায়ারের চিহ্ন ধরে আমি ছুটে যেতে থাকি। বালুর উপর টায়ারের চিহ্ন কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট। যখন পাথুরে এলাকা আসে তখন হঠাৎ করে টায়ারের চিহ্ন থাকে না। তখন মোটর বাইক থেকে নেমে আবার ভালো করে খুঁজতে হয়। আমি মোটর বাইকের চিহ্ন ধরে যেতে যেতে ধীরে ধীরে টিশার মোটর বাইক চালানোর কায়দাটুকু মোটামুটি বুঝে ফেলেছি। ঘণ্টা দুয়েক চালানোর পর সে মোটর বাইক থামিয়ে বিশ্রাম নেয়। রোদ যখন কড়া হয়ে উঠেছে তখন সে বড় বড় পাথরের ছায়ার আড়ালে বিশ্রাম নিয়েছে। এক জায়গায় তাকে বালুতে শুয়ে পড়তেও দেখেছি। হাতের একটা আঙুল কেটে ফেলে এসেছে, রক্তপাত বন্ধ করার জন্য সে ঘেঁড়া কাপড় দিয়ে হাত বেঁধে রেখেছে। রক্তে মাখামাখি সে রকম ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোও পেয়েছি।
মোটর বাইক চালিয়ে যেতে যেতে টিশা যে ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে গেছে সেটাও আমি বুঝতে পেরেছি। তার মোটর বাইকের গতি কমে এসেছে, সোজা না গিয়ে সে এলোমেলোভাবে গিয়েছে। একটু পরপর বিশ্রাম নিয়েছে। আমি বুকের ভেতর টিশার জন্য অদ্ভুত এক ধরনের মায়া অনুভব করতে থাকি। আগে কখনোই আমি কারো জন্য এরকম অনুভব করিনি।
ধীরে ধীরে রোদটা মাথার উপর উঠে এল। প্রচণ্ড গরমে আমার জিব শুকিয়ে আসে, মনে হয় যতটুকু পানি আছে সেটা ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলি। কিন্তু আমি খেলাম না, উঁচু হয়ে থাকা একটা বড় পাথরের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দুই ঢোক পানি খেয়ে আবার ছুটে যেতে থাকি।
আমি এক ধরনের শঙ্কা নিয়ে লক্ষ করলাম ধীরে ধীরে টিশার মোটর বাইক চালানোটুকু এলোমেলো হতে শুরু করেছে, সে কোন দিকে যাচ্ছে মনে হয় যেন নিজেও ভালো করে জানে না–শুধু তাই নয় একসময় মনে হলো সে বৃত্তাকারে ঘুরছে। এক জায়গায় মনে হলো সে একটা পাথরে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে গেছে। মনে হলো সে কিছুক্ষণ নিচে পড়ে ছিল, তারপর কষ্ট করে উঠেছে, আবার খানিকদূর গিয়েছে, আবার থেমেছে। আবার গিয়েছে।
আমি নিজেও আর যেতে পারছিলাম না। মরুভূমির ভয়ংকর রোদ থেকে রক্ষা করার জন্য কিছু আনিনি। গরম বাতাস আগুনের হলকার মতো আমার চোখে-মুখে লাগছে। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় আমার বুক ফেটে যেতে চাইছে। খুব সাবধানে মুখে কয়েক ফোঁটা পানি দিয়েছি–জিব শুকিসে। কিন্তু আমিধশ্রাম নিয়ে।
আমি পানি খেয়ে শেষ করতে চাই না। আমি যদি টিশাকে খুঁজে পাই তাহলে এই পানি আমার থেকে বেশি দরকার হবে টিশার।
আমি রোদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য একটা বড় পাথরের ছায়ায় দাঁড়ালাম। প্রচণ্ড রোদে চারদিক ঝলসে যাচ্ছে। দিগন্ত বিস্তৃত বালু ধিকি ধিকি করে কাঁপছে। আমি দূরে তাকালাম, হঠাৎ মনে হলো বহুদূরে বালুতে কিছু একটা চকচক করছে। আমি চমকে উঠলাম–ওটা কি টিশার মোটর বাইক, নাকি আমার চোখের ভুল? এতদূর থেকে সেটা স্পষ্ট দেখা যায় না, শুধু রোদে মাঝে মাঝে একটুখানি চকচক করছে। আমি আর দেরি না করে মোটর বাইকে উঠে প্রায় গুলির মতো ছুটে যেতে থাকি, যতই কাছে যেতে থাকি ততই জিনিসটা স্পষ্ট হতে থাকে এবং কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝে গেলাম এটা আসলেই টিশার মোটর বাইক, কাত হয়ে পড়ে আছে। আমি কাছে গিয়ে থামলাম, টিশার পায়ের ছাপ। মোটর বাইক থেকে নেমে সে এলোমেলোভাবে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কাছাকাছি অনেকগুলো বড় বড় পাথরের স্তৃপ। টিশা নিশ্চয়ই এই পাথরের আড়ালে একটু ছায়ার মাঝে আশ্রয় নিয়েছে। আমি আমার মোটর বাইক থামিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম, “টিশা! টি–শা…”
কোনো প্রত্যুত্তর শোনা যায় কি না তার জন্য আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম কিন্তু কিছু শুনতে পেলাম না। আবার আমি গলা ফাটিয়ে ডাকলাম, কেউ উত্তর দিল না। তখন আমি পাথরের স্কুপের কাছে ছুটে যেতে থাকি। কাছাকাছি গিয়ে একটু ঘুরতেই আমি টিশাকে দেখতে পেলাম, শক্ত পাথরের উপর দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। জীবন আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। আমি চিৎকার করতে করতে ছুটে গেলাম, তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে হাতটা ধরলাম, গলার কাছে হাত দিয়ে দেখলাম খুব ক্ষীণভাবে তার পালসটি বোঝা যায়। এখনো বেঁচে আছে। টিশার চোখ দুটো বন্ধ, মুখটা অল্প একটু খোলা, শুকনো নীল ঠোঁট। নিঃশ্বাস নিচ্ছে কি নিচ্ছে না বোঝার উপায় নেই।
আমি টিশাকে সেখানে রেখে আবার পাগলের মতো আমার বাইকের কাছে ছুটে গেলাম, সেটাতে বসে আমি চালিয়ে টিশার কাছে নিয়ে আসি। পেছন থেকে খাবার আর পানির বোতলগুলো নিয়ে আমি টিশার কাছে এলাম। একটা বোতল খুলে সেখান থেকে একটু পানি টিশার মুখের মাঝে ঢেলে দিলাম। হাতে একটু পানি নিয়ে আমি তার মুখটা মুছে দিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম, “টিশা! টিশা! একবার তাকাও!”